আলেমদের প্রতিক্রিয়া: বিশ্ব ইজতেমা সরানোর প্রস্তাব ‘যুক্তিহীন’

আলেমদের প্রতিক্রিয়া: বিশ্ব ইজতেমা সরানোর প্রস্তাব ‘যুক্তিহীন’

বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলিগকে ধর্মীয় পর্যটন ঘোষণা এবং কাকরাইলে তাবলিগের মারকাজ মসজিদে সরকারি প্রশাসক নিয়োগের দাবিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠানো হয়েছে। নোটিশে ধর্ম মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (ডিজি), বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ও কাকরাইলে তাবলিগের মারকাজ মসজিদের প্রধানকে বিবাদী করা হয়েছে।

বিগত ৩০ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. মাহমুদুল হাসান এ লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। এই নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে কাকরাইলে তাবলিগের মারকাজ মসজিদে সরকারি প্রশাসক নিয়োগ করতে হবে। অন্যথায় এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মহামান্য হাইকোর্টে রিট দায়ের করা হবে বলেও উল্লেখ করা হয় নোটিশে।

এদিকে তাবলিগের মুরুব্বি ও ওলামায়ে কেরামের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে মো. মাহমুদুল হাসান এ লিগ্যাল নোটিশ। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না তাবলিগের মুরুব্বিরা। ইজতেমার ময়দানকে স্থানান্তর করার পেছনে হয়রানি ব্যতিত অন্য কোনো ফায়দা দেখছেন না কাকরাইলের মুরুব্বিরা। ওলামায়ে কেরামও তাবলিগের ইজতেমাকে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখার পরামর্শ দিয়েছেন।

তাবলিগকে বানিজ্যকরণ করে টঙ্গী থেকে কক্সবাজার নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবটি সম্পূর্ণ যুক্তিহীন ও অবান্তর বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার বাংলাদেশ-এর পরিচালক মাওলানা আরশাদ রাহমানী।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই জায়গাটা দীনি কাজের জন্য নির্ধারণ করে গেছেন, তার আকাঙ্খা অনুযায়ী দীনের সেই কাজ দীর্ঘকাল ধরে টঙ্গির তুরাগ তীরে চলে আসছে। প্রতিনিয়ত এই মাঠে আল্লাহ তায়ালার দীনের পথে মেহনতকারী সাথী ভাইদের সওয়াবের ভাগ তিনি পাচ্ছেন। এখান থেকে ইজতেমা সরালে সেই সওয়াব থেকে তিনি বঞ্চিত হবেন।”

তাবলিগের মতো দীনি কাজকে হাস্যরসে পরিণত করা, বানিজ্যিকরণ করার মতো দৃষ্টিভঙ্গি লালন করা মোটেও উচিৎ নয় বলে উল্লেখ করেছেন বিশিষ্ট এ আলেম।

মাওলানা আরশাদ রাহমানী বলেন, “তাবলিগের কাজ একটি দীনি কাজ, এটাকে বানিজ্যিকরণ করার মতো চিন্তা-চেতনা আমরা কেউ লালন করি না। দেশের ওলামায়ে কেরাম যারা তাবলিগের সাথে কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের মধ্য থেকে ১ ভাগও মানুষও এই অশুভ প্রস্তাবের পক্ষে মতামত দেবেন বলে আমি মনে করি। সুতরাং, তাদের আশা-আকাঙ্খা ও দীনের মেহনতকে বাণিজ্যিকরণ করে দীনের এই কাজকে ছোট করার কোনো মানে হয় না। তাবলিগের কাজ যেভাবে চলছে, সেভাবেই চলতে দেওয়া উচিৎ।”

শায়খ যাকারিয়া ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারের মহাপরিচালক মুফতি মিযানুর রহমান সাঈদ বলেন, “নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেম ধর্মচর্চার পরিবর্তে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী। বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার চেয়ে মানুষের কাছ থেকে উপহার, দানবাবদ অর্থ নিতে বেশি আগ্রহী।

“উপরোক্ত ভাষায় আমরা কী বুঝতে পারি! ওলামায়ে কেরাম ও তাবলিগের মুরুব্বিদের নামের সাথে যে ধরনের ট্যাগ লাগানো হয়েছে, এটা বাস্তব পরিপন্থী। আলেম সমাজ ধর্মচর্চার চেয়ে রাজনীতিতে বেশি আগ্রহী- এই কথাটা পুরোটাই অবান্তর। চিন্তা করে দেখুন, শুধু ঢাকা শহরে কত হাজার মাদরাসা আছে! কয় হাজার মাদরাসার মুহাদ্দিস, শাইখুল হাদিস বা মুহতামিম রাজনীতি করেন? এটা হয়তো ১০ থেকে ১৫ ভাগ হবে। বাকি কেউ সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয়। তারা দীনের অন্যান্য দায়িত্ব পালন করছেন।

রাজনীতি করাও দীনের একটি অন্যতম দায়িত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, “যারা রাজনীতি করে তাদের ব্যস্ততাও শুধু রাজনীতিতে সীমাবদ্ধ নয়। তারা দরস-তাদরিসে সময় দিচ্ছেন। মসজিদের ইমাম-খতিব, তাবলিগের সাথী, মুহাদ্দিস, মুদাররিস সবাই তারা দীনের দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি রাজনীতিতে সময় দেন। এটাও দীনের অন্যতম দায়িত্ব।”

“নোটিশে উল্লেখিত আরেকটি বিষয় হলো বাংলাদেশের অধিকাংশ ধর্মীয় নেতা ও আলেম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত হওয়ার চেয়ে মানুষের কাছ থেকে উপহার, দানবাবদ অর্থ নিতে বেশি আগ্রহী। এ প্রসেঙ্গে আমি বলব, আলেম-ওলামা সাধারণ সমস্যা নিয়ে বেশি কথা বলেন। ঢাকার মসজিদে মসজিদে খোঁজ-খবর নিয়ে দেখতে পারেন, মসজিদের মিম্বার থেকে দীনি আলোচনার পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তারা কথা বলেন। ব্যক্তিজীবন গঠন, পারিবারিক জীবন গঠন, সুদ-ঘুষ, যিনা-ব্যাভিচার, দুর্নীতি ও জনজীবনের নানা অসঙ্গতি নিয়ে তারা আলোচনা করেন। কীভাবে ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইসলামকে ফলো করতে হবে, সেসব নিয়ে আলোচনা করেন। ”

তিনি বলেন, “ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রয়োজন কেউ কোনদিন অস্বীকার করতে পারবে না। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে বলেই দেশে ইসলামের চর্চা আছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো জনমানুষের অর্থে পরিচালিত হয়ে আসছে। এতে দেশ-জাতি ও ইসলামের সার্বিক কল্যাণ নিহিত। তারা নিজের জন্য কালেকশন করেন না, প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য করে থাকেন।”

“দীনি কাজে সময় দেওয়ার পাশাপাশি আলেমরা জীবিকা নির্বাহের জন্য পরিশ্রম করেন। তারা খুব ভালো আছেন, আল্লাহ তায়ালা তাদের রোজগারে বিশেষ বারাকাহ দেন। অল্প বেতন বা সামান্য টাকায় তারা সবসময় সন্তুষ্ট থাকেন। ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব থেকে এ ধরণের বাক্যগুলো এসেছে।” যোগ করেন মুফতি মিজানুর রহমান।

বিশ্ব ইজতেমাকে মক্কায় অনুষ্ঠিত হজের সাথে তুলনা করা বোকামি ছাড়া কিছু নয় বলে মন্তব্য করেছেন জামিয়া ইসলামিয়া বায়তুন নূরের মুহতামিম মাওলানা মনিরুজ্জামান।

তিনি বলেন, “সৌদি আরবে সারা বিশ্ব থেকে মুসলিমরা হজ ও ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে যায়। এখান থেকে সৌদি সরকার মুনাফা অর্জন করে। সুতরাং, ইজতেমা যেহেতু হজের পরেই বিশ্বে সবচেয়ে বড় ধর্মীয় সমাবেশ, এখান থেকে বোধহয় অর্থনিতক ফায়দা নেওয়া যেতে পারে। এই চিন্তাটা অবান্তর। কারণ, হজ ও বিশ্ব ইজতেমার প্রেক্ষাপট ভিন্নতর।”

“হজ একটি ফরজ বিধান। নেসাব পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হলে ইসলামি শরিয়ত হজ পালনের হুকুম করে। মুসলিম জীবনে হজের গুরুত্ব অপরীসিম। নোটিশ প্রেরণকারী হয়তো জানেন না, হজ ফরজ হলে মানুষ আল্লাহর ঘরে যেতে বাধ্য।”

“কিন্তু বিশ্ব ইজতেমার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যদি বলি, প্রথমেই বলতে হবে তাবলিগের কথা, দীনের দাওয়াতের কথা। দীনি দাওয়াত দেওয়া একজন মুসলিমের অন্যান্য দীনি দায়িত্বের মতোই একটি কাজ। মাদরাসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা, দারস-তাদরিস, খানকা থেকে পীর-বুযুর্গদের আলোচনা ইত্যাদি সবই দীনি দায়িত্ব, তাবলিগের কাজটিও এমন একটি দায়িত্ব। আর বিশ্ব ইজতেমা হচ্ছে এই মহান কাজের সঙ্গে জড়িত সকলের মিলনমেলা। সুতরাং, এখানে যে সকল সাথী ভাইয়েরা আসেন দীনি কাজ করার জন্য আসেন। কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সুতরাং, বিশ্ব ইজতেমাকে হজের সাথে তুলনা করা বোকামি।” বললেন মাওলানা মনিরুজ্জামান।

তাবলিগতে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা উচিৎ, বাণিজ্যিকরণ কোনো ফায়দা নিয়ে আসবে না। আর ইজতেমা রাজধানী কেন্দ্রিক থাকাটাই সবার জন্য ফায়দাজনক হবে বলে মনে করেন এই আলেম।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *