খিলাফাত ও হুকুমতঃ আমাদের আবেগের খতিয়ান! -মুফতী লুৎফর রহমান ফরায়েজী

খিলাফাত ও হুকুমতঃ আমাদের আবেগের খতিয়ান! -মুফতী লুৎফর রহমান ফরায়েজী
আমাদের সাম্প্রতিক লেখাগুলোয় আমার প্রিয় অনেক মানুষ কষ্ট পাচ্ছেন। অনেকে হা করে বলছেন: ‘এসব কী?’। অনেকে উপদেশ দিচ্ছেন: ‘হযরত আপনাকে মোহাব্বত করি আব্বাসীর প্রতি বিরোধের কারণে এমন করবেন না’। ইন্নালিল্লাহ। কারো প্রতি বিরোধের কারণে ইসলামের বিধানাবলী নিয়ে আমি ইচ্ছেমত লিখবো এতো বড় দুঃসাহস আমার হয় কী করে?

আসলে যারা এসব লেখায় অবাক হচ্ছেন। বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমিও আপনাদের দলের একজন ছিলাম যখন এ বিষয়ক পড়াশোনা না করেছি। রাষ্ট্রবিজ্ঞান একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র। শুধু কতিপয় মাথামোটা বক্তার বক্তব্য শুনেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া আমাদের এ বিষয়ে ভুল ধারণার মূল কারণ। আমি দৃঢ়তার সাথে আবারো বলছি: খিলাফাতই একমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার পদ্ধতি নয়। এটা আবেগী বক্তব্য নয়। সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাসের বাস্তব চিত্র। আরো অনেক পদ্ধতিই ইসলামী রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচনের পদ্ধতি।

কেন এ বিষয়ে কলম ধরছি?

শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দী রহঃ, শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমাদ মাদানী রহঃ, আল্লামা শাব্বির আহমাদ উসমানী রহঃ, মুফতী কেফায়াতুল্লাহ দেহলবী রহঃ। পরবর্তীতে মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর রহঃ, শাইখুল হাদীস আজীজুল হক রহঃ, মুজাহিদে মিল্লাত মুফতী ফজলুল হক আমীনী রহঃ, মাওলানা ফজলুল করীম পীর সাহেব চরমোনাই রহঃ সহ আমাদের আকাবিরে উলামা খিলাফাতের নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়াই ইসলামী হুকুমতের প্রচেষ্টা করে গেছেন।

তবে তারা অবশ্যই কুরআন ও সুন্নাহের এবং খিলাফাতে রাশেদার নীতি ও নৈতিকতা ও আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যেই এমনটি করেছেন। যদিও পদ্ধতি খিলাফাতের ছিল না। এখন কতিপয় আবেগী ব্যক্তিরা যেভাবে বক্তব্য দিচ্ছে, মুরব্বীদের প্রতি উগ্রতা ছড়াচ্ছে, এর ফলে নতুন প্রজন্ম এসকল শেরেতাজ উলামাদের প্রতি এক ধরণের তাচ্ছিল্য মানোবৃত্তি লালন করছে। এ কারণে এ বিষয়ক বাস্তব চিত্র সামনে আসা জরুরী মনে করছি। এর মানে এই নয় যে, আমি পশ্চিমা গণতন্ত্র সাপোর্ট করছি। কিংবা আমাদের আকাবিরগণ পশ্চিমা গণতন্ত্র সাপোর্ট করেছেন। তবে ভিন্ন পন্থায় ইসলামী হুকুমতের প্রবক্তা ছিলেন সকলেই।

আমি আমার নিজের বক্তব্য তুলে ধরছি না। হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ, ইদ্রিস কান্ধলবী রহঃ, মুফতী তাকী উসমানী দামাত বারাকাতুহুমের বক্তব্য শুধু তুলে ধরছি। কিন্তু এরপরও আমাদের ভাইরা মানতে পারছেন না। আমাকে লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছেন। অথচ আমিতো লক্ষ্যবস্তু নই। আমিতো কেবলি নাকেল মাত্র।

একটি বাস্তব কথা বলি!

ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। কিন্তু ইসলামে সকল বিষয়ের সামগ্রিক বিষয় বিস্তারিত বলা নেই। তবু কিভাবে ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা? আসলে পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা বলতে কী বুঝায়? ইসলাম কেন সার্বজনীন ধর্ম? এ দু’টি বিষয় না বুঝার কারণেই মূলত আমাদের মাঝে এ ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়। আসল কারণ হলো? ইসলাম পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা মূলনীতিগতভাবে। সকল বিষয়ের খুটিনাটি বিষয়ও উল্লেখ করে দেয়া আল্লাহর পক্ষ থেকে যেমন সম্ভব ছিল, তেমনি নবীজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে প্রকাশ করাও সম্ভব ছিল। কিন্তু এতে করে উম্মতের তা মুখস্ত করা সম্ভব ছিল না।

যদি কুরআনে সব কিছুই উল্লেখ করা হতো, তাহলে এ কুরআন কার মুখস্ত করার সাধ্য হতো?

উদাহরণতঃ এক নিয়তের মাসআলায় কোটি কোটি মাসআলা রয়েছে।

বিয়ে ভালো নিয়তে করলে সওয়াব হবে, খারাপ নিয়তে করলে গোনাহ হবে। মসজিদে নামাযের নিয়তে গেলে সওয়াব হবে, জুতা চুরির নিয়তে গেলে গোনাহ হবে। বাজারে হালাল ব্যবসার নিয়তে গেলে সওয়াব হবে, হারাম ব্যবসার নিয়তে গেলে গোনাহ হবে। এমন কোটি মাসআলা এক নিয়তের উপর ভিত্তিশীল।

এখন সব কুরআনে উল্লেখ থাকলে বা হাদীসে উল্লেখ থাকলে সেই কুরআন মুখস্ত আর সেই হাদীস গ্রন্থ কয়জনের পুরো পড়ার সামর্থ থাকতো? ইসলাম সার্বজনীন হওয়ার আসলে এখানেই তার প্রকৃত মহত্ম। ইসলাম কিয়ামত পর্যন্তের সকল জনপদের, সকল মানুষের ধর্ম হবার এটাই সবচে’ বড় প্রমাণ। এখানে এমন সব মূলনীতি দেয়া আছে যে, কিয়ামত পর্যন্ত সকল বিষয়ে মূলনীতিগত সমাধান নিহিত। অনেক বিষয়ের পদ্ধতি ও পন্থার নির্দিষ্ট সূরত বলে দেয়া হয়নি। আগত উম্মতের হাতে এর দায়িত্বভার চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা কুরআন ও সুন্নাহের সেই সকল মূলনীতি সামনে রেখে উম্মতকে রাহনূমায়ী করবেন।

এটা উম্মতে মুহাম্মদীর একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। যেমন:

আধুনিক অর্থনীতি বা ব্যাংকিং ব্যবস্থার পূর্ণ বিবরণ কুরআন ও সুন্নাহে নেই। কিন্তু মূলনীতি আছে। তেমনি রাষ্ট্রনায়ক নির্বাচন ও রাষ্ট্রপরিচালনার পদ্ধতি কুরআন ও সুন্নাহে একটি পদ্ধতিকে নির্ধারিত করে যায়নি। এটা উম্মতের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে মূলনীতি অবশ্যই বলে দেয়া হয়েছে। সেই মূলনীতির আলোকে যুগের মুত্তাবা উলামাগণ কোন পদ্ধতিকে কুরআন ও সুন্নাহের মূলনীতির আলোকে গ্রহণ করতে পারেন। এটা ইসলামের ক্যারেশমাটিক একটি দিক। সকল জনপদ, সকল সময়ের সার্বজনীন ধর্ম হবার একটি প্রকিষ্ঠ প্রমাণ।

খিলাফাতে রাশেদায় রাষ্ট্রনায়ক কিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন?

হযরত আবূ বকর রাঃ খলীফা হয়েছেন উম্মতের সকলের ঐক্যমত্যে। কিন্তু হযরত উমর রাঃ এর খিলাফাতের পদ্ধতিটি ছিল কিছুটা ভিন্ন। হযরত আবূ বকর রাঃ হযরত উমর রাঃ কে খলীফা নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন দিয়ে যান। তারপর তিনিই উম্মতের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে খলীফা হন।

তৃতীয় খলীফা নির্বাচনে হযরত উমর রাঃ ছয়জন শুরার একটি বোর্ড গঠন করে যান। যাদেরকে নসিহত করে যান যেন অধিকাংশ আহলে শুরার রায়ের উপর ফায়সালা করা হয়। যদি তিনজন একদিকে, আর তিনজন আরেকদিকে হয়, তাহলে আব্দুল্লাহ বিন উমর রাঃ এর রায় জিজ্ঞাসা করে চারজন যেদিকে হবে সেই অনুপাতে রায় দেবার জন্য। [তারীখে ইবনে খালদূন-২/৫৬৮-৫৬৯]

চতুর্থ খলীফা নির্ধারণ জনগণের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে।

ইসলামী খিলাফাতের খলীফা নির্বাচনে পদ্ধতি আমরা একাধিক পাই। যথা-

১। সকলের ঐক্যমত্বে খলীফা হবেন।

২। এক খলীফা পরবর্তী খলীফা মনোনয়ন দিয়ে যাবেন।

৩। মজলিশে শুরার অধিকাংশের মতামতের ভিত্তিতে খলীফা নির্বাচনের এখতিয়ার প্রদান।

৪। জনগণের হাতে খলীফা নির্বাচন ছেড়ে যাওয়া।

এর মানে খিলাফাতে রাশেদার যুগেও খলীফা বা ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনের পদ্ধতি এক নয়। আর এর কোন একটিকে আবশ্যক বলে কেউ মত দেননি। বরং এটি যমানার উম্মতের শ্রেষ্ঠ উলামাদের মতামতের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এখানে একটি পদ্ধতিকে নির্দিষ্ট করে উম্মতকে গোমরাহ করা পথভ্রষ্ঠতা ছাড়া আর কিছু নয়।

হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহঃ বলেন,

হাদীসের উদ্দেশ্য হলো যে, খিলাফাতে রাশেদা ত্রিশ বছর ধারাবাহিকভাবে থাকবে। তারপর বাদশাহী প্রাধান্য পাবে। খিলাফত হবে না। যদিও হয়ও, তবুও তা রাশেদাহ হবে না। অথবা হলেও তা ধারাবাহিক হবে না। যেমন খিলাফাতে উমর বিন আব্দুল আজীজ রহঃ। [ইমদাদুল ফাতাওয়া, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী, মৃত্যু ১৯৪৩ ঈসাব্দ, খণ্ড-৪, পৃষ্ঠা-৪৮০]

মুফতী তাকী উসমানী বলেন:

হাকীকত হলো, মুলুকিয়্যাত, বাদশাহী বা সালতানাত, নাম যাই হোক না কেন। আসল কথা হলো যে, তার অধিকার বা ক্ষমতা কতটুকু? এবং কোন মূলনীতির উপর ভিত্তি করে সে হুকুমত করে?

যদি এসব বিষয় ঠিক থাকে, তাহলে চাই তার নাম মুলিকিয়্যাত রাখুক, চাই তার নাম খিলাফাত রাখুক, এবং যা চায় নাম রাখুক। এর দ্বারা কোন পার্থক্য হবে না। এবং এটাকে খারাপ বলা যাবে না। [ইসলাম আওর সিয়াসী নজরিয়্যাত-৩০]

লিখেছেন – মুফতী লুৎফর রহমান ফরায়েজী

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল ও ফেসবুক পেইজে আপনাকে স্বাগতম

Please Follow USHalaltune.com | Facebook 

Please Subscribe USHalal Tune Blog | Youtube

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *