তাবলিগ জামাতের মেহনতে আলেমদের অবদান

তাবলিগ জামাতের মেহনতে আলেমদের অবদান

বর্তমান বিশ্বে আল্লাহর দিকে আহবানকারী সফল, কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য দাওয়াতি কাফেলার নাম “তাবলিগ জামাত।” এই জামাতের নিবেদিতপ্রাণ কিছু আত্মত্যাগী মুমিন বান্দারা নিঃস্বার্থভাবে প্রতিনিয়ত মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করতে থাকে।

ইসলামের ছয়টি বিশেষ আমলকে সামনে রেখে তারা এই মহান কাজ আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছে। তাদের পদচারণায় সারা দুনিয়ায় দিক-দিগন্ত মুখরিত। তাদের এই সাধনার বদৌলতে আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে হেদায়েতের শাশ্বত জ্যোতি পৌঁছে গেছে, কোটি কোটি প্রাণে। বেনামাজি নামাজ ধরেছে। স্রষ্টাকে ভুলে থাকা মানুষ চিনেছে স্রষ্টাকে নতুন ভাবে। পথভোলা মানুষের মাঝে দ্বীনের শাশ্বত বাণী পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে এবং মানুষের মাঝে দ্বীন চর্চা ছড়িয়ে দেয়ার মহান উদ্দেশ্য নিয়ে সর্বপ্রথম “দারুল উলুম দেওবন্দ” থেকেই তাবলীগ জামাতের আবির্ভাব ঘটে।

দ্বীন কায়েমের অন্যান্য আয়োজনের মতো তাবলীগ জামাতও ওলামায়ে দেওবন্দের-ই অবদান। যুগান্তকারী এ দাওয়াতি কাজের সূচনা করেছিলেন বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত সাধক, দারুল উলুম দেওবন্দের কৃতি সন্তান মাওলানা ইলিয়াস কান্ধলভি রহ.। যিনি ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র ও শায়খুল হিন্দ আল্লামা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দির রহ. স্নেহাস্পদ শিষ্য।

১৩২৬ হিজরিতে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন এবং শায়খুল হিন্দের (রহ.) কাছে বুখারী শরীফ ও তিরমিযী শরীফ অধ্যায়ন করেন। মুসলিম উম্মাহ-র ক্রান্তিকালে ১৯২৬ সালে দিল্লির দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত ‘মেওয়াত’ অঞ্চল থেকে তাবলিগ জামাতের যাত্রা শুরু হয়। যেখানের মানুষ নামে মুসলিম ছিল ঠিকই, কিন্তু তাদের কাজকর্ম ছিল বহু ক্ষেত্রে আরবের জাহিলি যুগের মতই। এই এলাকা থেকেই তাবলিগ জামাতের দাওয়াতি কাজের সূচনা হয়।

সর্বপ্রথম হযরতজী ইলিয়াস কান্দলভী রহ. জনসাধারণের মধ্যে কালেমা ও নামাজের দাওয়াত দেন এবং জামাতবদ্ধ হয়ে বিভিন্ন এলাকায় যেয়ে, দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেন। এভাবেই তিনি গ্রামে গ্রামে সৎ কাজ করার এবং সৎকাজে আহবান করার জামাত তৈরি করে দেন। হযরতজী রহ. যখন উপলব্ধি করলেন, এইসব দরিদ্র, গ্রাম্য লোকদের মাদ্রাসায় গিয়ে ইলম অর্জন সম্ভব নয়, তখন তিনি ছোট ছোট জামাত আকারে ইলমি ও দীনি প্রতিষ্ঠানগুলোতে গিয়ে সময় কাটাতে তাদের উদ্বুদ্ধ করেন ও ধর্মীয় পরিবেশে তাদেরকে তালিম দিতে থাকেন।

সেসব ধর্মীয় মজলিসে ওলামা-মাশায়েখের ওয়াজ-নসিহতের পাশাপাশি তাদের দৈনন্দিন জীবনের মাসআলা-মাসায়েল বাতলে দেওয়া হতো। সাধারণ মানুষ ওলামা, মাশায়েখদের সংস্পর্শে এসে তাদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, আচার- আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে এবং তাদের আগামী দিনের সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হতে থাকে।

পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে এই জামাতের প্রতি মানুষের আকর্ষণ। তাবলীগ জামাতের এই কাফেলা শুরু থেকে আজ অব্দি ওলামায়ে কেরামের মাধ্যমে পরিচালিত হয়ে আসছে এবং এর উসুল ও যাওয়াবেত কোরআন হাদিসের আলোকে ওলামায়ে ক্রোমের মাধ্যমেই সুবিন্যস্ত। সুতরাং নিঃসন্দেহে বলা যায়, এর উদ্দেশ্যে অটল থাকতে এবং এর সক্রিয়তা বজায় রাখতে ওলামায়ে কেরামের নেতৃত্ব ও নির্দেশনার বিকল্প নেই।

হযরত আবদুল্লাহ বিন আমর রাযি. থেকে বর্ণিত-রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বান্দাদের কাছ থেকে ইলম ছিনিয়ে নেবেন না; কিন্তু তিনি উলামায়ে কেরামকে উঠিয়ে নেয়ার মাধ্যমে ইলমও উঠিয়ে নেবেন। এভাবে যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না তখন মানুষ কিছু মূর্খ লোকের শরণাপন্ন হবে। অতঃপর (ধর্মীয় বিষয়ে) তাদের প্রশ্ন করা হবে, তারা ইলম ছাড়াই ফতোয়া দেবে। এর ফলে তারা নিজেরাও গোমরাহ হবে এবং মানুষকেও গোমরাহ করবে।”-(সহীহ বুখারী ১/২০; সহীহ মুসলিম ২/৩৪০; জামে তিরমিযী ২/৯৩-৯৪; মেশকাতুল মাসাবীহ ১/৩৩) সুতরাং তাবলীগ জামাতের নেতৃত্বে উলামায়ে কেরামের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব কতটুকু তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না।

স্বয়ং আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজেই উলামায়ে কেরামের হাতে দাওয়াত ও তাবলীগের মহৎ দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন।

নবীজি সা. বলেছেন, “আলেমরা নবীগণের ওয়ারিস, আর নবীগণ কাউকে স্বর্ণ-রুপার ওয়ারিস বানাননি। তাঁরা ইলমের ওয়ারিস বানিয়েছেন।” সুতরাং ওহীর শাশ্বত জ্ঞান নবীগণের কাছে আসার পর তাঁদের যে দায়িত্ব ছিল, কিয়ামত পর্যন্ত আলেমদের উপর সেই একই দায়িত্ব অর্পিত। আম্বিয়ায়ে কেরাম যেভাবে মানুষের কাছে দ্বীন পৌঁছে দিয়েছেন, উলামায়ে কেরামও একইভাবে মানুষের কাছে দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছে দিবেন।

বিশ্ব ইজতিমা-২০২৩ সন্নিকটে। ইতিমধ্যেই মুসল্লিদের স্বাগত জানাতে সুসজ্জিত হয়েছে টঙ্গীর ময়দান। মুসলমানদের মাঝে ঈমানী চেতনা জাগ্রত করার এবং দ্বীনমুখী জীবনের আগ্রহ তৈরি করার আহ্বান নিয়ে প্রতিবছর আমাদের দেশে ইজতিমা অনুষ্ঠিত হয়। এদিক থেকেও এটি একটি বরকতময় ও মকবুল একটি জামাত।

এই ইজতেমা যেন তার মূল লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে সফল হতে পারে, ইজতিমার নানাবিধ মেহনতের দ্বারা যেন মুসলমানদের মাঝে দ্বীনের উপর চলার প্রেরণা জাগে, আল্লাহর ভয় ও আখিরাতে জবাবদিহিতার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, পার্থিব পদ-পদবী, অর্থ-বিত্তের মোহ-জাল থেকে বেরিয়ে আখিরাতমুখী জীবন-যাপনের গুরুত্ব যেন মানুষেরা অনুধাবন করতে পারে এবং পার্থিব স্বার্থে পরস্পরের হক নষ্ট করার পরিবর্তে আখিরাতের স্বার্থে একে অপরের অধিকার রক্ষার চেতনা জাগে-এর জন্য আল্লাহ তাআলার কাছে যেমন দুআ ও রোনাজারি প্রয়োজন, তেমনি নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী মেহনত-মুজাহাদাও প্রয়োজন। রব্বে কারীম আমাদেরকে ওলামায়ে কেরামের দিক-নির্দেশনা মেনে জীবন যাপন করার তৌফিক দান করুন এবং হেদায়েতের পথে নিজে চলে, অন্যকেও আহবান করার তাওফিক দান করুন! আমিন।

আহসানুল ইসলাম রাকিব
শিক্ষার্থী, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *