বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি?

বাংলাদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি?

কওমি সংশ্লিষ্ট আলেমরা দাবি করেন, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনসহ উপমহাদেশের স্বাধীনতা, ধর্ম ও মানবতার কল্যাণে এই ঘরানার মাদ্রাসার আলেমরা বেশ অবদান রেখেছেন। ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের মাধ্যমে এই শিক্ষাধারার আনুষ্ঠানিক সূচনা হয়৷ তবে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি—তা নিয়ে একটু ধোঁয়াশা রয়েই গেছে।

দেশের বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থ, ডায়েরি, সাময়িকী ইত্যাদিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এদেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা হলো সিলেটের ঝিংগাবাড়ি মাদ্রাসা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে একটি প্রাচীন মাদ্রাসা রয়েছে; যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭৪ সালে৷ কিন্তু এই মাদ্রাসাটি কওমি নয়; বরং এর নাম ঝিংগাবাড়ি ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা। যদিও এটি শুরু হয়েছিল মক্তব শিক্ষা দিয়ে। তবে সেটি কি দেওবন্দের সিলেবাসের আদলে ছিল কিনা তা স্পষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না৷ মাদ্রাসাটির বর্তমান প্রিন্সিপাল মাওলানা হাফিজুর রহমানের দাবি, এটি কলকাতার আলিয়া সিলেবাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

তাহলে দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা আসলে কোনটি এ বিষয়ে অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলো আরও বিভ্রান্ত করে তোলে৷ সেখানে একেক জায়গায় একেকটি মাদ্রাসাকে “দেশের প্রচীনতম কওমি মাদ্রাসা’ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রতিবেদনে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে, তা হলো—প্রায় প্রতিটি প্রতিবেদনেই সিলেট অঞ্চলের কোনও না কোনও মাদ্রাসাকে দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উল্লিখিত মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো, হবিগঞ্জের জামিয়া সাদিয়া রায়ধর (রায়ধর মাদ্রাসা), একই জেলার জামিয়া কাসিমুল উলুম বাহুবল (বাহুবল মাদ্রাসা) এবং সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে অবস্থিত জামিয়া দারুল উলুম হেমু (হেমু মাদ্রাসা)।

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জামিয়া সাদিয়া রায়ধরের মুহতামিম মাওলানা আবু সালেহ সাদীর সঙ্গে। তিনি জানান, এই মাদ্রাসাটি (রায়ধর মাদ্রাসা) ১৮৯৫ সালে প্রতিষ্ঠিত। প্রতিষ্ঠাতা শাহ আসাদুল্লাহ (রহ.)। এ সময় মাওলানা সাদীকে জানানো হয়, তার পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে অনেকে দেশের অন্যতম প্রাচীন কওমি মাদ্রাসা আখ্যা দিচ্ছেন। এমন তথ্য জেনে তিনি বলেন, “আমার কাছে তেমনটি মনে হয় না; এর আগেও এদেশে কওমি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকতে পারে।”

তবে এ ব্যাপারে ‘আসলে স্পষ্ট ধারণা নেই বলেই স্বীকার করেন মাওলানা সাদী। তিনি জানান, তার পরিচালনাধীন প্রতিষ্ঠানটিও যে প্রথম না; সেটিও তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। আর যদি তার প্রতিষ্ঠানটি দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা হয়ও; সেটাও তিনি প্রমাণসহ দাবি করতে পারছেন না।

মুহতামিম মাওলানা আবু সালেহ সাদী বলেন, ‘প্রাচীন এ মাদ্রাসাটিতে বর্তমানে প্রায় ৪০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আর শিক্ষক ও স্টাফ সংখ্যা ১৮ জন। এখানে জামাতে জালালাঈন (স্নাতক) পর্যন্ত পড়ার সুযোগ আছে।’

যোগাযোগ করা হলে হবিগঞ্জের বাহুবল মাদ্রাসার নায়েবে মুহতামিম মাওলানা আজিজুর রহমান মানিক জানান, তাদের মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯০০ সালে। মানে চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসারও এক বছর আগে। তবে এটিকে তারা দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা দাবি করেন না।

মাওলানা মানিক বলেন, ঐতিহ্যবাহী এ মাদ্রাসায় দেশের অনেক বড় আলেম পড়াশোনা করেছেন৷ তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন –জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের সাবেক খতিব মরহুম মাওলানা ওবায়দুল হক, ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলাম ও মাওলানা জুবায়ের আহমাদ আনসারী (রহ.) প্রমুখ।

দেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা কোনটি এমন তথ্যের সন্ধানে ইন্টারনেটে পাওয়া প্রতিবেদনগুলোতে যে মাদ্রাসাটির নাম সবচেয়ে বেশি বার এসেছে, সেটি হলো সিলেটের হেমু মাদ্রাসা। যোগাযোগ করা হয় মাদ্রাসাটির শিক্ষাসচিব মাওলানা ইবরাহীমের সঙ্গে। তিনি এখানে ২০০৫ সাল থেকে খেদমত করছেন। মাওলানা ইবরাহীম জানান, তাদের মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকাল ১৮৭৯ সালে এবং তারা মনে করেন। তাদের মাদ্রাসাটিই দেশের প্রথম কওমি মাদ্রাসা।

মাদ্রসাটির বর্তমান শিক্ষাসচিব মাওলানা ইবরাহীম আরও বলেন, ‘হেমু মাদ্রাসা যে দেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা; এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউ তাদের বিরোধিতা করেননি।

সবপক্ষের বক্তব্য অনুযায়ী, দেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর বাজারে অবস্থিত জামিয়া দারুল উলুম হেমু (হেমু মাদ্রাসা)। তবে এর আগেও দেশে দারুল উলুম দেওবন্দের অনুকরণে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা থাকতে পারে৷ কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে এটিকেই বাংলাদেশের সর্বপ্রথম কওমি মাদ্রাসা মনে করছেন আলেমরা।

হেমু মাদ্রাসার বর্তমান মুহতামিম মুফতি জিল্লুর রহমান কাসেমী। তার তত্ত্বাবধানে বর্তমানে এখানে ১১০০ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করেছে। এখানকার শিক্ষক ও স্টাফ সংখ্যা ৪২ জন। কওমি সিলেবাসের সর্বোচ্চ শ্রেণি দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল-মাস্টার্স সমমান) পর্যন্ত শিক্ষাধারা চালু রয়েছে এখানে। পরে এখানে উচ্চতর আরবি আদব (আরবি সাহিত্য) অনুষদও খোলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠা হয়। দেওবন্দের উসুলে হাশতে গানার? (আটটি নিয়ম বা শর্ত) ভিত্তিতে প্রথম কওমি মাদ্রাসা এই প্রতিষ্ঠানটি বলেও অনেক আলেম দাবি করেন।

 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *