হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) – এর মাক্কী জীবন

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) – এর মাক্কী জীবন
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মাক্কী জীবন – শৈশব থেকে নবুঅত
নবী জীবনকে আমরা প্রধান দু’টি ভাগে ভাগ করে নেব- মাক্কী জীবন ও মাদানী জীবন। মক্কায় তাঁর জন্ম, বৃদ্ধি ও নবুঅত লাভ এবং মদীনায় তাঁর হিজরত, ইসলামের বাস্তবায়ন ও ওফাত লাভ। আরবের মরুদুলাল শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম) হেজাযের মক্কা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন ও সেখানে জীবনের ৫৩টি বছর কাটান। যার মধ্যে ১৩ বছর ছিল নবুঅতী জীবন। অতঃপর তিনি মদীনায় হিজরত করেন ও সেখানে জীবনের বাকী ১০ বছর কাটান। অতঃপর সেখানেই ৬৩ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। এক্ষণে আমরা তাঁর বংশ পরিচয় ও জীবন বৃত্তান্ত পেশ করব।
পূর্বপুরুষ
ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্র ছিলেন ইসমাঈল ও ইসহাক্ক। ইসমাঈলের মা ছিলেন বিবি হাজেরা এবং ইসহাকের মা ছিলেন বিবি সারা। দুই ছেলেই ‘নবী’ হয়েছিলেন। ছোট ছেলে ইসহাকের পুত্র ইয়াকুবও ‘নবী’ হন। তাঁর অপর নাম ছিল ‘ইস্রাঈল’ অর্থ ‘আল্লাহর দাস’। সে মতে তাঁর বংশ বনু ইস্রাঈল’ নামে পরিচিত হয়। তাঁর বারো জন পুত্রের বংশধরগণের মধ্যে যুগ যুগ ধরে হাযার হাযার নবীর জন্ম হয়। ইউসুফ, মূসা, হারূণ, দাউদ, সুলায়মান ও ঈসা (‘আলাইহিমুস সালাম) ছিলেন এই বংশের সেরা নবী ও রাসূল। বলা চলে যে, আদম (আলাইহিস সালাম) হাতে ইবরাহীম (আলাইহিস সালাম) পর্যন্ত হযরত নূহ ও ইদরীস (আঃ) সহ ৮/৯ জন নবী ব্যতীত বাকী এক লক্ষ চবিবশ হাযার নবী-রাসূলের প্রায় সকলেই ছিলেন ইবরাহীম (আঃ)-এর কনিষ্ঠ পুত্র ইসহাক (আঃ)-এর বংশধর অর্থাৎ বনু ইস্রাঈল। যাদের সর্বশেষ নবী ও রাসূল ছিলেন হযরত ঈসা (আঃ)। অন্যদিকে হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর জ্যেষ্ঠ পুত্র ইসমাঈল (আঃ)-এর বংশে একজন মাত্র নবীর জন্ম হয় এবং তিনিই হ’লেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী ও রাসূল হযরত মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম)৷ ফলে আদম (আঃ) যেমন ছিলেন মানবজাতির আদি পিতা, নূহ (আঃ) ছিলেন মানব জাতির দ্বিতীয় পিতা, তেমনি ইবরাহীম (আঃ) ছিলেন তাঁর পরবর্তী সকল নবীর পিতা এবং তাঁদের অনুসারী উম্মতে মুসলিমাহর পিতা (হজ্জ ২২/৭৮)। ইবরাহীম (আঃ) আল্লাহর হুকুমে দ্বিতীয়া স্ত্রী হাজেরা ও তার পুত্র ইসমাঈলকে মক্কায় রেখে আসেন ও মাঝে-মধ্যে গিয়ে তাদের খোঁজ-খবর নিতেন। তাঁরা সেখানেই আমৃত্যু বসবাস করেন। অন্যদিকে তাঁর প্রথমা স্ত্রী সারা ও তার পুত্র ইসহাক ও অন্যদের নিয়ে তিনি কেন আনে (ফিলিস্তীনে) বসবাস করতেন এবং এখানেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে ইবরাহীম (আঃ)-এর দুই পুত্রের মাধ্যমে মক্কা ও শাম (ফিলিস্তীন) দুই অঞ্চলে তাওহীদের প্রচার ও প্রসার ঘটে।
কুরআনে বর্ণিত পঁচিশ জন নবীর মধ্যে আদম, নূহ, ইদরীস ও মুহাম্মাদ (ছাঃ) বাদে বাকী ২১ জন নবী ছিলেন বনু ইস্রাঈল এবং একমাত্র মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন বনু ইসমাঈল। বলা চলে যে, এই বৈমাত্রেয় পার্থক্য উম্মতে মুহাম্মাদীর বিরুদ্ধে ইহুদী-নাছারাদের স্থায়ী বিদ্বেষের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। সেজন্য তারা চিনতে পেরেও এবং তাদের কিতাবে শেষনবীর নাম, পরিচয় ও তাঁর আগমনের কথা লিখিত থাকা সত্ত্বেও তারা তাঁকে মানেনি।
জন্ম ও মৃত্যু
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ১ম হস্তীবর্ষের ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার ছুবহে ছাদিকের পর মক্কায় নিজ পিতৃগৃহে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১১ হিজরী সনের ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার সকাল ১০টার দিকে মদীনায় মৃত্যুবরণ করেন।
রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল’। বিদায় হজ্জ হয়েছিল ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার। তিনি বিদায় হজ্জের পরে ৮০ বা ৮১ দিন বেঁচে ছিলেন। কেউ বলেছেন ৯০ বা ৯১ দিন (এটা ভুল)। আৰু মিখনাফ ও কালবী ওফাতের তারিখ ২রা রবীউল আউয়াল বলেছেন। ইবনু হিশামের ভাষ্যকার সুহায়লী সেটাকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। ইবনু হাজার বলেন,
“আবু মিখনাফ যেটি বলেছেন, সেটিই নির্ভরযোগ্য। অন্যদের ভুলের কারণ সম্ভবতঃ এটাই যে, তারা বলেছিলেন, রাসূল (সাঃ)-২রা রবীউল আউয়াল মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু পরে সেটি পরিবর্তিত হয়ে ১২ই রবীউল আউয়াল হয়ে গেছে। পরবর্তীতে লোকেরা কোনরূপ চিন্তা-ভাবনা না করেই উক্ত ভুলের অনুসরণ করে গেছেন’।তবে এটি মক্কার চাঁদের হিসাবে হাতে পারে। কেননা মক্কার চাঁদ মদীনার একদিন আগে ওঠে (আল-বিদায়াহ ৫/২২৪-২৫)। অতএব মদীনার হিসাবে ১লা রবীউল আউয়াল ওফাতের দিন হবে। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
সুলায়মান মানছুরপুরীর হিসাব মতে সৌরবর্ষ হিসাবে রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ৫৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে এপ্রিল সোমবার এবং মৃত্যু ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন সোমবার। চান্দ্রবর্ষ হিসাবে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর ৪দিন এবং সৌরবর্ষ হিসাবে ৬১ বছর ১ মাস ১৪ দিন। তাঁর জন্ম হয়েছিল আবরাহা কর্তৃক কা’বা আক্রমণের ৫০ দিন পরে (ইবনু হিশাম ১/১৫৮-টীকা ৪)। এটা ছিল ইবরাহীম (আঃ) থেকে ২৫৮৫ বছর ৭ মাস ২০ দিন পরে এবং নূহ (আঃ)-এর প্লাবনের ৩৬৭৫ বছর পরের ঘটনা। রাসূল (সাঃ)-দুনিয়াতে বেঁচে ছিলেন মোট ২২,৩৩০ দিন ৬ ঘণ্টা। তন্মধ্যে তাঁর নবুঅতকাল ছিল ৮১৫৬ দিন। সঠিক হিসাব আল্লাহ জানেন।
আব্দুল্লাহ্ মৃত্যু
পিতা আব্দুল্লাহ ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে তদীয় পিতা আব্দুল মুত্ত্বালিবের হুকুমে ইয়াছরিব (মদীনা) গেলে সেখানে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মাত্র ২৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। সেখানে তিনি নাবেগা জান্দীর গোত্রে সমাধিস্থ হন। এভাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) -এর জন্মের পূর্বে তাঁর পিতার মৃত্যু হয়ে যায়। উল্লেখ্য যে, মদীনার বনু নাজ্জার গোত্রে আব্দুল মুত্তালিবের পিতা হাশেম বিবাহ করেন। ফলে তারা ছিলেন আব্দুল মুত্তালিবের নানার গোষ্ঠী।
মৃত্যুকালে আব্দুল্লাহ যেসব সহায়-সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা ছিল যথাক্রমে পাঁচটি উট, এক পাল ছাগল এবং একটি নাবালিকা হাবশী দাসী বারাকাহ ওরফে উম্মে আয়মান। যিনি রাসূল (সাঃ)-কে শিশুকালে লালন-পালন করেন। ইনি পরে যায়েদ বিন হারেছার সাথে বিবাহিতা হন এবং উসামা বিন যায়েদ তাঁর পুত্র ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পাঁচ মাস পরে মৃত্যুবরণ করেন’।
আবু ত্বালিব
আবু ত্বালিবের নাম ছিল আব্দু মানাফ। কিন্তু তিনি আবু ত্বালিব নামেই প্রসিদ্ধি লাভ করেন। তাঁর ৪ পুত্র ও ২ কন্যা ছিল : ত্বালিব, ‘আক্বীল, জাফর ও আলী। ত্বালিব ‘আক্বীলের চাইতে দশ বছরের বড় ছিলেন।তাঁর মৃত্যুর অবস্থা জানা যায় না। বাকী সকলেই ছাহাবী ছিলেন। দুই কন্যা উম্মে হানী ও জুমানাহ দু’জনেই ইসলাম কবুল করেন’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/৭৫-৮৩ পৃঃ)। আব্দুল মুত্ত্বালিবের পরে আবু ত্বালিব বনু হাশিমের নেতা হন। তিনি আমৃত্যু রাসূল (সাঃ)-এর অকৃত্রিম অভিভাবক ছিলেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে বয়কটকালের তিন বছরসহ সর্বদা বনু মুত্বালিব ও বনু হাশিম রাসূল (সাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। যদিও আবু ত্বালিব ও অন্য অনেকে ইসলাম কবুল করেন নি।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আপন চাচাদের মধ্যে তিন ধরনের মানুষ ছিলেন। ১. যারা তাঁর উপরে ঈমান এনেছিলেন ও তাঁর সাথে জিহাদ করেছিলেন। যেমন হামযাহ ও আববাস (রাঃ)। ২. যারা তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু জাহেলিয়াতের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যেমন আবু ত্বালিব। ৩. যারা শুরু থেকে মৃত্যু অবধি শত্রুতা করেন। যেমন আবু লাহাব। উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ান ছিলেন বনু ‘আব্দে শামস গোত্রের, আবু জাহল ছিলেন বন্ধু মাখযূম গোত্রের এবং উমাইয়া বিন খালাফ ছিলেন বনু জুমাহ গোত্রের। যদিও সকলেই ছিলেন কুরায়েশ বংশের অন্তর্ভুক্ত এবং সবাই ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর সম্পর্কীয় চাচা।
খাৎনা ও নামকরণ
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সপ্তম দিনে নবজাতকের খাৎনা ও নামকরণ করা হয়। পিতৃহীন নবজাতককে কোলে নিয়ে স্নেহশীল দাদা আব্দুল মুতালিব কাবাগৃহে প্রবেশ করেন। তিনি সেখানে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেন ও প্রাণভরে দোআ করেন। আকীকার দিন সমস্ত কুরায়েশ বংশের লোককে দাওয়াত করে খাওয়ান। সকলে জিজ্ঞেস করলে তিনি বাচ্চার নাম বলেন, ‘মুহাম্মাদ’। এই অপ্রচলিত নাম শুনে লোকেরা বিস্ময়ভরে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, আমি চাই যে, আমার বাচ্চা সারা দুনিয়ায় ‘প্রশংসিত’ হৌক (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৪১)। ওদিকে স্বপ্নের মাধ্যমে ফেরেশতার দেওয়া প্রস্তাব অনুযায়ী মা আমেনা তার নাম রাখেন ‘আহমাদ’ (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/৩৯)। উভয় নামের অর্থ প্রায় একই। অর্থাৎ ‘প্রশংসিত’ এবং সর্বাধিক প্রশংসিত’।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নাম সমূহ
জুবাইর বিন মুত্ব’ইম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, আমার অনেকগুলি নাম রয়েছে। আমি মুহাম্মাদ (প্রশংসিত), আমি আহমাদ (সর্বাধিক প্রশংসিত), আমি ‘মাহী’ (বিদূরিতকারী)। আমার মাধ্যমে আল্লাহ কুফরীকে বিদূরিত করেছেন। আমি ‘হাশের’ (জমাকারী)। কেননা সমস্ত লোক ক্বিয়ামতের দিন আমার কাছে জমা হবে (এবং শাফাআতের জন্য অনুরোধ করবে)। আমি ‘আক্কেব’ (সর্বশেষে আগমনকারী)। আমার পরে আর কোন নবী নেই’। সুলায়মান মানছুরপুরী বলেন, উক্ত নাম সমূহের মধ্যে মুহাম্মাদ ও আহমাদ হ’ল তাঁর মূল নাম এবং বাকীগুলো হ’ল তাঁর গুণবাচক নাম। সেজন্য তিনি সেগুলির ব্যাখ্যা করেছেন। এই গুণবাচক নামের সংখ্যা মানছুরপুরী গণনা করেছেন ৫৪টি। তিনি ৯২টি করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন।
‘মুহাম্মাদ’ নামের প্রশংসায় চাচা আবু তালিব বলতেন,
“তাঁর মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য আল্লাহ নিজের নাম থেকে তার নাম বের করে এনেছেন। তাই আরশের মালিক হ’লেন মাহমূদ এবং ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ’।
লালন-পালন
জন্মের পর শিশু মুহাম্মাদ কিছুদিন চাচা আবু লাহাবের দাসী ছুওয়াইবার দুধ পান করেন। তাঁর পূর্বে চাচা হামযা বিন আব্দুল মুতালিব এবং তাঁর পরে আবু সালামাহ তার দুধ পান করেন।ফলে তাঁরা সকলে পরস্পরে দুধভাই ছিলেন।
এ সময় পিতা আব্দুল্লাহ্র রেখে যাওয়া একমাত্র মুক্তদাসী উম্মে আয়মন রাসূল (সাঃ)-কে শৈশবে লালন-পালন করেন। এরপর ধাত্রী হালীমা সাদিয়াহ তাঁকে প্রতিপালন করেন। অতঃপর হালীমার গৃহ থেকে আসার পর মা আমেনা তাকে সাথে নিয়ে মদীনায় স্বামীর কবর যিয়ারত করতে যান এবং ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করলে কিশোরী উম্মে আয়মন শিশু মুহাম্মাদকে সাথে নিয়ে মক্কায় ফেরেন। পরে খাদীজা (রাঃ)-এর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ্র সাথে তার বিয়ে হয়। অতঃপর তার গর্ভে উসামা বিন যায়েদের জন্ম হয়। রাসূল (সাঃ) উম্মে আয়মানকে ‘মা’  বলে সম্বোধন করতেন এবং নিজ পরিবারভুক্ত বলতেন। তিনি তাকে ‘মায়ের পরে মা’ বলে সম্মানিত করতেন।
সে সময়ে শহরবাসী আরবদের মধ্যে এই ধারণা প্রচলিত ছিল যে, শহরের জনাকীর্ণ পংকিল পরিবেশ থেকে দূরে গ্রামের নিরিবিলি উন্মুক্ত পরিবেশে শিশুদের লালন-পালন করলে তারা বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি হ’তে মুক্ত থাকে এবং তাদের স্বাস্থ্য সুঠাম ও সবল হয়। সর্বোপরি তারা বিশুদ্ধ আরবী ভাষায় কথা বলতে অভ্যস্ত হয়। সে হিসাবে দাদা আব্দুল মুতালিব সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত ধাত্রী হিসাবে পরিচিত বনু সা’দ গোত্রের হালীমা সানিয়াহকে নির্বাচন করেন এবং তার হাতেই প্রাণাধিক পৌত্রকে সমর্পণ করেন। হালীমার গৃহে দু’বছর দুগ্ধপানকালীন সময়ে তাদের পরিবারে সচ্ছলতা ফিরে আসে। তাদের ছাগপালে এবং অন্যান্য সকল বিষয়ে আল্লাহর তরফ থেকে বরকত নেমে আসে। নিয়মানুযায়ী দু’বছর পরে বাচ্চাকে ফেরত দেওয়ার জন্য তাঁকে মা আমেনার কাছে আনা হয়। কিন্তু হালীমা তাকে ছাড়তে চাচ্ছিলেন না। তিনি আমেনাকে বারবার অনুরোধ করেন আরও কিছুদিন বাচ্চাকে তার কাছে রাখার জন্য। ঐ সময় মক্কায় মহামারী দেখা দিয়েছিল। ফলে মা রাযী হয়ে যান এবং বাচ্চাকে পুনরায় হালীমার কাছে অর্পণ করেন (আর-রাহীক্ব ৫৬ পৃঃ)।
বক্ষ বিদারণ
দ্বিতীয় দফায় হালীমার নিকটে আসার পর জন্মের চতুর্থ কিংবা পঞ্চম বছরে শিশু মুহাম্মাদের সীনা চাক বা বক্ষ বিদারণের বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। ব্যাপারটি ছিল এই যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদের সাথে খেলছিলেন। এমন সময় জিবরাঈল ফেরেশতা এসে তাকে কিছু দূরে নিয়ে বুক চিরে ফেলেন। অতঃপর কলীজা বের করে যমযমের পানি দিয়ে ধুয়ে কিছু জমাট রক্ত ফেলে দেন এবং বলেন, ‘এটি তোমার মধ্যেকার শয়তানের অংশ’। অতঃপর বুক পূর্বের ন্যায় জোড়া লাগিয়ে দিয়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে যান। পুরা ব্যাপারটি খুব দ্রুত সম্পন্ন হয়। সাথী বাচ্চারা ছুটে গিয়ে হালীমাকে খবর দিল যে, মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে। তিনি ছুটে এসে দেখেন যে, মুহাম্মাদ মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে’। হালীমা তাকে বুকে তুলে বাড়ীতে এনে সেবা-যত্ন করতে থাকেন। এই অলৌকিক ঘটনায় হালীমা ভীত হয়ে পড়েন এবং একদিন তাঁকে তার মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে যান। তখন তার বয়স ছিল ছয় বছর। তাঁর দ্বিতীয়বার বক্ষবিদারণ হয় মিরাজে গমনের পূর্বে মক্কায়।
দাদার স্নেহনীড়ে মুহাম্মাদ
পিতৃ-মাতৃহীন ইয়াতীম মুহাম্মাদ এবার এলেন প্রায় ৮০ বছরের বৃদ্ধ দাদা আব্দুল মুত্তালিবের স্নেহনীড়ে। আব্দুল মুত্ত্বালিব নিজেও ছিলেন জন্ম থেকে ইয়াতীম। সেই শিশুকালের ইয়াতীম আব্দুল মুতালিব আজ বৃদ্ধ বয়সে নিজ ইয়াতীম পৌত্রের অভিভাবক হন। কিন্তু এ স্নেহনীড় বেশী দিন স্থায়ী হয়নি।
মাত্র দু’বছর পরে শিশু মুহাম্মাদের বয়স যখন ৮ বছর, তখন তার দাদা আব্দুল মুতালিব ৮২ বছর বয়সে মক্কায় ইন্তেকাল করেন। ফলে তাঁর অছিয়ত অনুযায়ী আপন চাচা আবু ত্বালিব তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং আমৃত্যু প্রায় চল্লিশ বছর যাবৎ তিনি ভাতীজার যোগ্য অভিভাবক হিসাবে জীবনপাত করেন।
শিশু মুহাম্মাদের কিছু বরকতমন্ডিত নিদর্শন
(১) ধাত্রীমাতা হালীমা সা’দিয়াহ বলেন, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় আমার বুকের দুধ শুকিয়ে গিয়েছিল। বাহন মাদী গাধাটির অবস্থাও ছিল করুণ। কেননা এ সময় আরব ভূমিতে দুর্ভিক্ষের বছর চলছিল। ফলে বেশী অর্থ পাবে না বলে ইয়াতীম মুহাম্মাদকে কেউ নিতে চাচ্ছিল না। অবশেষে আমি তাকে নিতে সম্মত হ’লাম। অতঃপর যখন তাকে বুকে রাখলাম, তখন সে এবং আমার গর্ভজাত সন্তান দু’জনে পেট ভরে আমার বুকের দুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গেল। ওদিকে উটনীর পালান দুধে ভরে উঠল। যার দুধ আমরা সবাই তৃপ্তির সাথে পান করলাম। তখন আমার স্বামী হারেছ বললেন, ‘হালীমা! আল্লাহর কসম! তুমি এক মহা ভাগ্যবান সন্তান লাভ করেছ। তারপর বাড়ীতে ফিরে আসার সময় দেখা গেল যে, আমাদের সেই দুর্বল মাদী গাধাটি এত তেয়ী হয়ে গেছে যে, কাফেলার সবাইকে পিছনে ফেলে সে এগিয়ে যাচ্ছে। যা দেখে সবাই বিস্মিত হয়ে গেল।
(২) বাড়ীতে ফিরে এসে দেখা গেল আমাদের রাখাল যে চারণভূমিতে পঙ্গপাল নিয়ে যেত অন্যান্য রাখালরাও সেখানে তাদের পশুপাল নিয়ে যেত। কিন্তু তাদের পশুগুলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় ফিরত। অথচ আমাদের পশুপাল তৃপ্ত অবস্থায় এবং পালানে দুধভর্তি অবস্থায় বাড়ী ফিরত। এভাবে আমরা প্রতিটি ব্যাপারেই বরকত লক্ষ্য করলাম এবং আমাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরে এল
(৩) কাবা চত্বরের যে নির্দিষ্ট স্থানটিতে দাদা আব্দুল মুতালিব বসতেন, সেখানে তার জন্য নির্দিষ্ট আসনে কেউ বসতো না। কিন্তু শিশু মুহাম্মাদ ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি এসে সরাসরি দাদার আসনেই বসে পড়তেন। তার চাচারা তাকে সেখান থেকে নামিয়ে দিতে চাইলে দাদা আব্দুল মুত্তালিব তাকে নিজের কাছেই বসাতেন ও গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলতেন, আমার এ বেটাকে ছেড়ে দাও। আল্লাহর কসম এর মধ্যে বিশেষ কিছু শুভ লক্ষণ আছে’।
উল্লেখ্য যে, ভাতীজার প্রশংসায় পঠিত আবু তালিবের কবিতা,
“শুভ্র দর্শন (মুহাম্মাদ) যার চেহারার অসীলায় বৃষ্টি প্রার্থনা করা হয়ে থাকে। সে যে ইয়াতীমদের আশ্রয়স্থল ও বিধবাদের রক্ষক’ যা তিনি পাঠ করেছিলেন মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নবুঅত লাভের পর কুরাইশদের চরম হুমকির সময়। এর মাধ্যমে তিনি মন্থার নেতাদেরকে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন এবং বলতে চেয়েছিলেন যে, কোন অবস্থাতেই তিনি মুহাম্মাদকে তাদের দাবী মতে তাদের হাতে ছেড়ে দিবেন না। ইবনু হিশাম বলেন, উক্ত প্রসঙ্গে আবু তালিব ৮০ লাইনের যে দীর্ঘ কবিতা পাঠ করেন, তা আমার নিকটে বিশুদ্ধভাবে এসেছে। তবে কোন কোন বিদ্বান এর অধিকাংশ কবিতা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৭২-৮০)।
এক্ষণে শিশুকালে তাঁকে নিয়ে চাচা কা’বাগৃহে গিয়ে তাঁর অসীলায় এই দো’আ করেছিলেন বলে তাবাকাতে ইবনে সাদ, বায়হাক্বী দালায়েলুন নবুঅত প্রভৃতি গ্রন্থে যে বর্ণনা এসেছে তার সনদ ‘যঈফ’ (মা শা-আ ১৪-১৫ পৃঃ)। বরং মদীনাতে গিয়ে অনাবৃষ্টির সময় লোকদের দাবীর প্রেক্ষিতে জুমআর খুৎবায় মিম্বরে দাঁড়িয়ে রাসূল (সাঃ) বৃষ্টি প্রার্থনা করেছেন এবং সে বৃষ্টিতে মদীনা সিক্ত হয়েছে। রাসূল (সাঃ)-এর বৃষ্টি প্রার্থনার সময় আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত উপরোক্ত কবিতার লাইনটি পাঠ করতেন’। ইবনু কাছীর (রহঃ) আবু ত্বালিবের পঠিত দীর্ঘ কবিতাকে বহুবিশ্রুত সাবআ মু’আল্লাকার কবিতাসমূহের চাইতে অধিক উত্তম ও সারগর্ভ বলে মত প্রকাশ করেছেন’।জনৈক বেদুঈন ব্যক্তির আবেদনক্রমে রাসূল (সাঃ) মিম্বরে উঠে আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করে বলেন, হে আল্লাহ! আমাদের প্রতি বৃষ্টি বর্ষণ করা। উক্ত হাদীছে এ কথাও রয়েছে, রাসূল (সাঃ) বলেন | যদি আজ আবু তালিব বেঁচে থাকতেন, তাহ’লে তার দু’চক্ষু শীতল হয়ে যেত। অতঃপর তিনি বলেন, কে আমাদেরকে তাঁর সেই কথাগুলি শুনাবে? তখন আলী (রাঃ) দাঁড়িয়ে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সম্ভবতঃ আপনি তাঁর কবিতার সেই কথা বলছেন। যেখানে তিনি বলেছেন, (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/২৩৮)। ইবনু হাজার বলেন, আনাস (রাঃ) বর্ণিত উক্ত হাদীছটির মধ্যে কিছু দুর্বলতা থাকলেও এটিকে সহযোগী হিসাবে গ্রহণ করা যায়।
উক্ত দীর্ঘ কবিতা সম্পর্কে সীরাতে ইবনে হিশামের ভাষ্যকার আব্দুর রহমান সুহায়লী (মৃ. ৫৮১ হি.) বলেন, আবু তালেব স্বীয় পিতা আব্দুল মুত্তালিবের সময়ে এটা দেখেছেন যে, অনাবৃষ্টিতে কাতর মক্কাবাসীদের জন্য বৃষ্টি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে তিনি নারী-পুরুষ সবাইকে নিয়ে কাবাগৃহে জমা হন এবং আল্লাহর নিকট বৃষ্টি প্রার্থনা করেন। এ সময় শিশু মুহাম্মাদ তাঁর পাশে ছিল এবং তিনি তাকে কাঁধে তুলে নেন। অতঃপর মুষলধারে বৃষ্টি বর্ষিত হয় (ইবনু হিশাম ১/২৮১, টীকা-২)। তবে উক্ত প্রার্থনায় আব্দুল মুত্তালিব উপস্থিত নারী-পুরুষ সকলের দোহাই দিয়েছেন। অতএব উক্ত ঘটনায় মুহাম্মাদের পৃথক বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত হয় না।
কিশোর মুহাম্মাদ ও ব্যবসায় গমন
১০ বা ১২ বছর বয়সে চাচার সাথে ব্যবসা উপলক্ষে তিনি সর্বপ্রথম সিরিয়ার বুছরা ) ( শহরে গমন করেন। সেখানে জিরজীস )  ( ওরফে বাহীরা ( নামক জনৈক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাহেব অর্থাৎ খ্রিষ্টান পাদ্রীর সাথে সাক্ষাৎ হ’লে তিনি মক্কার কাফেলাকে আন্তরিক আতিথেয়তায় আপ্যায়িত করেন এবং কিশোর মুহাম্মাদের হাত ধরে কাফেলা নেতা আবু তালেবকে বলেন, এই বালক বিশ্ব জাহানের নেতা। একে আল্লাহ বিশ্ব চরাচরের রহমত হিসাবে প্রেরণ করবেন’। আবু তালেব বললেন, কিভাবে আপনি একথা বুঝলেন? তিনি বললেন, গিরিপথের অপর প্রান্ত থেকে যখন আপনাদের কাফেলা দৃষ্টি গোচর হচ্ছিল, তখন আমি খেয়াল করলাম যে, সেখানে এমন কোন প্রস্তরখন্ড বা বৃক্ষ ছিল না, যে এই বালকের প্রতি সিজদায় পতিত হয়নি। আর নবী ব্যতীত এরা কাউকে সিজদা করে না। তাছাড়া মেঘ তাঁকে ছায়া করছিল। গাছ তার প্রতি নুইয়ে পড়ছিল। এতদ্ব্যতীত ‘মোহরে নবুঅত’ দেখে আমি তাকে চিনতে পেরেছি, যা তার (বাম) স্কন্ধমূলে ছোট্ট ফলের আকৃতিতে উঁচু হয়ে আছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থে আখেরী নবীর এসব আলামত সম্পর্কে আমরা আগেই জেনেছি। অতএব হে আবু ত্বালেব! আপনি সত্বর একে মক্কায় পাঠিয়ে দিন। নইলে ইহুদীরা জানতে পারলে ওকে মেরে ফেলতে পারে’। অতঃপর চাচা তাকে কিছু গোলামের সাথে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। এ সময় পাদ্রী তাকে পিঠা ও তৈল উপহার দেন।
ইবনু ইসহাক বলেন, পাদ্রী বাহীরা তাকে পৃথকভাবে ডেকে নিয়ে লাত ও উযযার দোহাই দিয়ে কিছু প্রশ্ন করেন। তখন তরুণ মুহাম্মাদ তাকে বলেন, আমাকে লাত ও “উযযার নামে কোন প্রশ্ন করবেন না। আল্লাহর কসম! আমি এদু’টির চাইতে কোন কিছুর প্রতি অধিক বিদ্বেষ পোষণ করি না। অতঃপর তিনি তাকে তার নিদ্রা, আচরণ আকৃতি ও অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেন। সেগুলিতে তিনি তাদের কিতাবে বর্ণিত গুণাবলীর সাথে মিল পান। অতঃপর তিনি আবু তালিবকে বলেন, ছেলেটি কে? আবু তালিব বলেন, এটি আমার বেটা। তিনি বললেন, না। এটি আপনার পুত্র নয়। এই ছেলের বাপ জীবিত থাকতে পারেন না। তখন আবু তালিব বললেন, এটি আমার ভাতিজা। বাহীরা বললেন, তার পিতা কি করেন? জবাবে আবু তালিব বলেন, তিনি মারা গেছেন এমতাবস্থায় যে তার মা গর্ভবতী ছিলেন। বাহীরা বললেন, আপনি সত্য বলেছেন। আপনি ভাতিজাকে নিয়ে আপনার শহরে চলে যান এবং ইহুদীদের থেকে সাবধান থাকবেন। … আপনার ভাতিজার মহান মর্যাদা রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/১৮২)।
কিছু কিছু খ্রিষ্টান প্রাচ্যবিদ এই ঘটনা থেকে নবী চরিত্রের উপরে অপবাদ দিতে চেষ্টা করেছেন যে, তিনি পাদ্রী বাহীরা-র নিকট থেকে তাওরাত শিখেছিলেন। যা থেকে তিনি কুরআন বর্ণনা করেছেন।[2] অথচ তখন তাওরাত বা ইনজীল আরবীতে অনূদিত হয়নি। তাছাড়া মুহাম্মাদ (সাঃ) তখন ছিলেন মাত্র ১০/১২ বছরের বালক। যিনি মাতৃভাষা আরবীতেই লেখাপড়া জানতেন না (আনকাবুত ২৯/৪৮)। তিনি ও তাঁর বংশের সবাই ছিলেন উম্মী বা নিরক্ষর। তাহ’লে কিভাবে এই সংক্ষিপ্ত সাক্ষাতে তিনি পাদ্রীর নিকট থেকে তাওরাত শিখলেন, যা হিব্রু ভাষায় লিখিত। কিভাবে তিনি তার অর্থ বুঝলেন? অতঃপর সেগুলি কিভাবে সাক্ষাতের ২৮/৩০ বছর পর আরবীতে পরিবর্তন করে ‘কুরআন’ আকারে পেশ করলেন?
তরুণ মুহাম্মাদ ও ‘ফিজার’ যুদ্ধ
তিনি যখন পনের কিংবা বিশ বছর বয়সে উপনীত হন, তখন ‘ফিজার যুদ্ধ’ শুরু হয়। এই যুদ্ধে একপক্ষে ছিল কুরায়েশ ও তাদের মিত্র বন্ধু কিনানাহ এবং অপর পক্ষে ছিল কায়েস আয়লান। যুদ্ধে কুরায়েশ পক্ষের জয় হয়। কিন্তু এ যুদ্ধের ফলে ‘হারাম’ মাস (যে মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ) এবং কাবার পবিত্রতা বিনষ্ট হয় বলে একে ‘হারবুল ফিজার’ বা দুষ্টুদের যুদ্ধ বলা হয়। তরুণ মুহাম্মাদ এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং চাচাদের তাঁর যোগান দেবার কাজে সহায়তা করেন বলে যে বর্ণনা বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে রয়েছে, তা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।  বরং এটাই সঠিক যে, আল্লাহপাক তাঁকে হারাম মাসে যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাপ থেকে রক্ষা করেন। যেমন জন্ম থেকেই আল্লাহ তাঁকে সকল মন্দকর্ম থেকে রক্ষা করেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/১১৪)।
হিলফুল ফুযূল
ফিজার যুদ্ধের ভয়াবহতা স্বচক্ষে দেখে দয়াশীল মুহাম্মাদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া হয়। যাতে ভবিষ্যতে এরূপ ধ্বংসলীলা আর না ঘটে, সেজন্য তিনি গভীর চিন্তায় মগ্ন হন। এই সময় হঠাৎ একটি ঘটনা ঘটে যায়। যুবায়েদ  গোত্রের জনৈক ব্যক্তি ব্যবসা উপলক্ষে মক্কায় এসে অন্যতম কুরায়েশ নেতা আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকটে মালামাল বিক্রয় করেন। কিন্তু তিনি মূল্য পরিশোধ না করে মাল আটকে রাখেন। তখন লোকটি অন্য নেতাদের কাছে সাহায্য চাইলে কেউ এগিয়ে আসেনি। ফলে তিনি ভোৱে আৰু কুবায়েস পাহাড়ে উঠে সবাইকে উদ্দেশ্য করে উচ্চকণ্ঠে হৃদয় বিদারক কবিতা আবৃত্তি করতে থাকেন। রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা যুবায়ের বিন আব্দুল মুতালিব এই আওয়ায শুনে ছুটে যান এবং ঘটনা অবহিত হয়ে তিনি অন্যান্য গোত্র প্রধানদের নিকটে গমন করেন। অতঃপর তিনি সর্বজনশ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা আব্দুল্লাহ বিন জুদ আন তায়মীর গৃহে গোত্রপ্রধানদের নিয়ে বৈঠক করেন। উক্ত বৈঠকে রাসূল (সাঃ)-এর দাদা ও নানার গোত্র সহ পাঁচটি গোত্র যোগদান করে। তারা হ’ল বনু হাশেম, বনু মুত্বালিব, বনু আসাদ, বনু যোহরা ও বনু তাইম বিন মুররাহ। উক্ত বৈঠকে তরুণ মুহাম্মাদ কতগুলি কল্যাণমূলক প্রস্তাব পেশ করেন, যা নেতৃবৃন্দের প্রশংসা অর্জন করে। অতঃপর চাচা যুবায়েরের দৃঢ় সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে চারটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। মূলতঃ ভাতিজা মুহাম্মাদ ছিলেন উক্ত কল্যাণচিন্তার উদ্ভাবক এবং পিতৃব্য যোবায়ের ছিলেন তার প্রথম ও প্রধান সমর্থক। চুক্তিগুলি ছিল নিম্নরূপ :
(১) আমরা সমাজ থেকে অশান্তি দূর করব (২) মুসাফিরদের হেফাযত করব (৩) দুর্বল ও গরীবদের সাহায্য করব এবং (৪) যালেমদের প্রতিরোধ করব’। হারবুল ফিজারের পরে যুলকা’দাহ্র ‘হারাম’ মাসে আল্লাহর নামে এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি সম্পাদনের পরপরই তারা ‘আছ বিন ওয়ায়েল-এর নিকট যান এবং তার কাছ থেকে উক্ত মযলূম যুবায়দী ব্যবসায়ীর প্রাপ্য হক বুঝে দেন। এরপর থেকে সারা মক্কায় শান্তির সুবাতাস বইতে শুরু করে এবং কুরাইশগণ এই কল্যাণকামী সংগঠনকে ‘হিলফুল ফুযূল’ বা ‘কল্যাণকামীদের সংঘ’ বলে আখ্যায়িত করেন।একে ‘পবিত্রাত্মাদের সংঘ’ বলেও অভিহিত করা হয়েছে (আহমাদ হা/১৬৫৫)। অথচ ইতিপূর্বে নিয়ম ছিল গোত্রীয় বা দলীয় কোন ব্যক্তি শত অন্যায় করলেও তাকে পুরা গোত্র মিলে সমর্থন ও সহযোগিতা করতেই হ’ত। যেমন আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজে ন্যায় অন্যায় বাছ-বিচার ছাড়াই দলীয় ব্যক্তির সমর্থনে নেতা-কর্মীরা করে থাকেন। এমনকি আদালতও প্রভাবিত হয়।
হিলফুল ফুযূল-এর গুরুত্ব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি আমার চাচাদের সঙ্গে হিলফুল ফুযূলে অংশগ্রহণ করি, যখন আমি বালক ছিলাম। অতএব আমি মূল্যবান লাল উটের বিনিময়েও উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করতে রাযী নই’ (আহমাদ হা/১৬৫৫, ১৬৭৬; সিলসিলা ছহীহাহ হা/১৯০০)।
আল-আমীন মুহাম্মাদ
হিলফুল ফুযূল গঠন ও তার পরপরই যবরদস্ত কুরায়েশ নেতার কাছ থেকে বহিরাগত মযলুমের হক আদায়ের ঘটনায় চারিদিকে তরুণ মুহাম্মাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। সবার মুখে মুখে তিনি ‘আল-আমীন’ অর্থাৎ বিশ্বস্ত ও আমানতদার বলে অভিহিত হ’তে থাকেন। অল্পবয়স হওয়া সত্ত্বেও কেউ তার নাম ধরে ডাকতো না। সবাই শ্রদ্ধাভরে ‘আল আমীন’ বলে ডাকত।
বিবাহ
ব্যবসায়ে অভাবিত সাফল্যে খাদীজা দারুণ খুশী হন। অন্যদিকে গোলাম মায়সারার কাছে মুহাম্মাদের মিষ্টভাষিতা, সত্যবাদিতা, আমানতদারী এবং উন্নত চিন্তা-চেতনার কথা শুনে বিধবা খাদীজা মুহাম্মাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে পড়েন। ইতিপূর্বে পরপর দু’জন স্বামী মৃত্যুবরণ করায় মক্কার সেরা নেতৃবৃন্দ তাঁর নিকটে বিয়ের পয়গাম পাঠান। কিন্তু তিনি কোনটাই গ্রহণ করেননি। এবার তিনি নিজেই বান্ধবী নাফীসার মাধ্যমে নিজের বিয়ের পয়গাম পাঠালেন যুবক মুহাম্মাদ-এর কাছে। তখন উভয় পক্ষের মুরববীদের সম্মতিক্রমে শাম থেকে ফিরে আসার মাত্র দুমাসের মাথায় সমাজনেতাদের উপস্থিতিতে ধুমধামের সাথে তাদের বিবাহ সম্পন্ন হয়। মুহাম্মাদ স্বীয় বিবাহের মোহরানা স্বরূপ ২০টি উট প্রদান করেন। এ সময় খাদীজা ছিলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ ধনী ও সম্ভ্রান্ত মহিলা এবং সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারিণী হিসাবে ‘তাহেরা’ (পবিত্রা) নামে খ্যাত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৪০ এবং মুহাম্মাদের বয়স ছিল ২৫। মুহাম্মাদ ছিলেন খাদীজার তৃতীয় স্বামী। অন্যদিকে খাদীজা ছিলেন মুহাম্মাদের প্রথমা স্ত্রী।উভয়ের দাম্পত্য জীবন পঁচিশ বছর স্থায়ী হয়। মৃত্যুকালে খাদীজার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তবে উভয়ের বয়স নিয়ে মতভেদ আছে।
সন্তান-সন্ততি
তাঁর মোট ৩ পুত্র ও ৪ কন্যা ছিল। ইবরাহীম ব্যতীত বাকী ৬ সন্তানের সবাই ছিলেন খাদীজার গর্ভজাত। তিনি বেঁচে থাকা অবধি রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয় বিবাহ করেননি। মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর সাথে বিয়ের সময় খাদীজা পূর্ব স্বামীদ্বয়ের কয়েকজন জীবিত সন্তানের মা ছিলেন। তাঁর গর্ভজাত ও পূর্বস্বামীর সন্তানেরা সকলে ইসলাম কবুল করেন ও সকলে ছাহাবী ছিলেন। খাদীজার গর্ভে রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম সন্তান ছিল ক্বাসেম। তার নামেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপনাম ছিল আবুল কাসেম। অতঃপর কন্যা যয়নব, পুত্র আব্দুল্লাহ; যার লকব ছিল ত্বাইয়িব ও তাহের। কারণ তিনি নবুঅত লাভের পর জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অতঃপর রুকাইয়া, উম্মে কুলছুম ও ফাতেমা। কাসেম ছিলেন সন্তানদের মধ্যে সবার বড়। যিনি ১৭ মাস বয়সে মারা যান। নবুঅত লাভের পর আব্দুল্লাহ জন্ম গ্রহণের কিছু দিনের মধ্যেই মৃত্যুবরণ করায় আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-কে ‘আবতার’ বা নির্বংশ বলে অভিহিত করেন। কেননা সে যুগে কারু পুত্র সন্তান মারা গেলে এবং পরে পুত্র সন্তান হ’তে দেরী হ’লে আরবরা ঐ ব্যক্তিকে ‘আবতার’ বলত। অতঃপর চার কন্যার মধ্যে কে সবার বড় ও কে সবার ছোট এ নিয়ে মতভেদ আছে। তবে প্রসিদ্ধ মতে যয়নব বড় ও ফাতেমা ছিলেন ছোট।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মোট সাত সন্তানের ছয় জনই তাঁর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাদের মধ্যে পুত্রগণ শৈশবে মারা যান। কন্যাগণ সকলে বিবাহিতা হন ও হিজরত করেন। কিন্তু ফাতেমা ব্যতীত বাকী তিন কন্যা রাসূল (সাঃ)-এর জীবদ্দশায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর ছয় মাস পরে ফাতেমা (রাঃ) মারা যান। রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ সন্তান ছিলেন পুত্র ‘ইবরাহীম’। তিনি ছিলেন মিসরীয় দাসী মারিয়া কিবতীয়ার গর্ভজাত। যিনি মদীনায় জন্মগ্রহণ করেন এবং দুধ ছাড়ার আগেই মাত্র ১৮ মাস বয়সে ১০ম হিজরীর ২৯শে শাওয়াল মোতাবেক ৬৩২ খৃষ্টাব্দের ২৭ অথবা ৩০শে জানুয়ারী সূর্য গ্রহণের দিন সোমবার মদীনায় ইন্তেকাল করেন।
কা’বাগৃহ পুনর্নির্মাণ ও মুহাম্মাদের মধ্যস্থতা
আল-আমীন মুহাম্মাদ-এর বয়স যখন ৩৫ বছর, তখন কুরায়েশ নেতাগণ কা’বাগৃহ ভেঙ্গে পুনর্নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। ইবরাহীম ও ইসমাঈলের হাতে গড়া ন্যূনাধিক আড়াই হাযার বছরের স্মৃতিধন্য এই মহা পবিত্র গৃহ সংস্কারের ও পুনর্নির্মাণের পবিত্র কাজে সকলে অংশীদার হাতে চায়।
ইবরাহীমী যুগ থেকেই কা’বাগৃহ ৯ হাত উঁচু চার দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর ছিল, যার কোন ছাদ ছিল না। কা’বা অর্থই হ’ল চতুর্দেওয়াল বিশিষ্ট ঘর। চার পাশের উঁচু পাহাড় থেকে নামা বৃষ্টির স্রোতের আঘাতে কা’বার দেওয়াল ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। তাছাড়া সে বছরের তীব্র বন্যায় কা’বা ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম হয়। অধিকন্তু একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঐ সময় ঘটে যায়, যা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি এবং যা কাবা পুনর্নির্মাণে প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে কাজ করে। ঘটনাটি ছিল এই যে, কিছু চোর দেওয়াল টপকে কা’বা গৃহে প্রবেশ করে এবং সেখানে রক্ষিত মূল্যবান মালামাল ও অলংকারাদি চুরি করে নিয়ে যায়।
কা’বাগৃহ পুনর্নির্মাণের উদ্দেশ্যে কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ বৈঠকে বসে স্থির করেন যে, এর নির্মাণ কাজে কারু কোনরূপ হারাম মাল ব্যয় করা হবে না। তারা বলেন, হে কুরায়েশগণ! তোমরা এর নির্মাণ কাজে তোমাদের পবিত্র উপার্জন থেকে ব্যয় কর। এর মধ্যে ব্যভিচারের অর্থ, সূদের অর্থ, কারু প্রতি যুলুমের অর্থ মিশ্রিত করোনা’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৪)। অতঃপর কোন কোন গোত্র মিলে কোন পাশের দেওয়াল নির্মাণ করবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়ে যায়। সাথে সাথে এবার ছাদ নির্মাণের প্রস্তাব গৃহীত হয়, যা ইতিপূর্বে ছিল না। কিন্তু কে আগে দেওয়াল ভাঙ্গার সূচনা করবে? অবশেষে অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযূমী সাহস করে প্রথম ভাঙ্গা শুরু করেন। তারপর সকলে মিলে দেওয়াল ভাঙ্গা শেষ করে ইবরাহীম (আঃ)-এর স্থাপিত ভিত পর্যন্ত গিয়ে ভাঙ্গা বন্ধ করে দেন। অতঃপর সেখান থেকে নতুনভাবে সর্বোত্তম পাথর দিয়ে বাকুম’  নামক জনৈক রোমক কারিগরের তত্ত্বাবধানে নির্মাণকার্য শুরু হয়। কিন্তু গোল বাঁধে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে হাজারে আসওয়াদ’ স্থাপনের পবিত্র দায়িত্ব কোন গোত্র পালন করবে সেটা নিয়ে। এই বিবাদ অবশেষে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গড়াবার আশংকা দেখা দিল। তখন প্রবীণ নেতা আবু উমাইয়া মাখযুমী প্রস্তাব করলেন যে, আগামীকাল সকালে যে ব্যক্তি সর্বপ্রথম ‘হারামে’ প্রবেশ করবেন, তিনিই এই সমস্যার সমাধান করবেন। সবাই এ প্রস্তাব মেনে নিল।
আল্লাহর অপার মহিমা। দেখা গেল যে, বনু শায়বাহ ফটক দিয়ে সকালে সবার আগে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করলেন সকলের প্রিয় ‘আল-আমীন’। কা’বা নির্মাণে অংশগ্রহণকারী ও প্রত্যক্ষদর্শী রাবী আব্দুল্লাহ বিন সায়েব আল-মাখযুমীর বর্ণনা মতে তাকে দেখে সবাই বলে উঠলো- এই যে আল-আমীন। আমরা তাঁর উপর সন্তুষ্ট। এই যে মুহাম্মাদা। অতঃপর তিনি ঘটনা শুনে একটা চাদর চাইলেন এবং সেটা বিছিয়ে নিজ হাতে ‘হাজারে আসওয়াদ’ উঠিয়ে তার মাঝখানে রেখে দিলেন। অতঃপর নেতাদের বললেন, আপনারা সকলে মিলে চাদরের চারপাশ ধরে নিয়ে চলুন। তাই করা হ’ল। কা’বার নিকটে গেলে তিনি পাথরটি উঠিয়ে যথাস্থানে রেখে দিলেন। এই দ্রুত ও সহজ সমাধানে সবাই সন্তুষ্ট হয়ে মুহাম্মাদের তারীফ করতে করতে চলে গেল। আরবরা এমন এক যুদ্ধ থেকে বেঁচে গেল, যা ২০ বছরেও শেষ হাত কি-না সন্দেহ। এ ঘটনায় সমগ্র আরবে তাঁর প্রতি ব্যাপক শ্রদ্ধাবোধ জেগে উঠলো। নেতাদের মধ্যে তাঁর প্রতি একটা স্বতন্ত্র সম্ভ্রমবোধ সৃষ্টি হ’ল।
উল্লেখ্য যে, নবুঅত লাভের পূর্ব পর্যন্ত কুরায়েশগণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে শ্রদ্ধাভরে আল-আমীন বলেই ডাকত’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৮)।
কাবাগৃহ নির্মাণের এক পর্যায়ে উত্তরাংশের দায়িত্বপ্রাপ্ত বনু আদী বিন কা’ব বিন লুওয়াই তাদের হালাল অর্থের কমতি থাকায় কাজ সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হয়। ফলে মূল ভিতের ঐ অংশের প্রায় সাত হাত জায়গা বাদ রেখেই দেওয়াল নির্মাণ করা হয়। যা হাতীম বা পরিত্যক্ত নামে আজও ঐভাবে আছে। সেকারণ হাতীমের বাহির দিয়েই তাওয়াফ করতে হয়, ভিতর দিয়ে নয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা বিজয়ের পরে ঐ অংশটুকু কাবার মধ্যে শামিল করে মূল ইবরাহীমী ভিতের উপর কাবা পুনর্নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নওমুসলিম কুরায়েশরা সেটা মেনে নিবে না ভেবে বিরত থাকেন’ (বুখারী হা/১৫৮৬)। একারণেই বলা হয়ে থাকে মন্দ প্রতিরোধ অধিক উত্তম কল্যাণ আহরণের চাইতে’। উল্লেখ্য যে, হিজরতের ১৮ বছর পূর্বে কা’বাগৃহ পুনর্নির্মাণ সমাপ্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ১/১৯৭-এর টীকা-৩)।
নতুনের শিহরণ ও খাদীজার বিচক্ষণতা
নতুন অভিজ্ঞতায় শিহরিত মুহাম্মাদ (সাঃ) দ্রুত বাড়ী ফিরলেন। স্ত্রী খাদীজাকে বললেন, শিগগীর আমাকে চাদর মুড়ি দাও। চাদর মুড়ি দাও’। কিছুক্ষণ পর ভয়ার্তভাব কেটে গেলে সব কথা স্ত্রীকে খুলে বললেন। রাসূল (সাঃ) এর নিকটে খাদীজা কেবল স্ত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন তাঁর নির্ভরতার প্রতীক ও সান্ত্বনার স্থল। ছিলেন বিপদের বন্ধু। তিনি অভয় দিয়ে বলে উঠলেন, এটা খারাব কিছুই হ’তে পারে না কখনোই না। আল্লাহর কসম! তিনি কখনোই আপনাকে অপদস্থ করবেন না। আপনি আত্মীয়দের সঙ্গে সদাচরণ করেন, দুস্থদের বোঝা বহন করেন, নিঃস্বদের কর্মসংস্থান করেন, অতিথিদের আপ্যায়ন করেন এবং বিপদগ্রস্তকে সাহায্য করেন’। বস্তুতঃ সে যুগে কেউ কোন মর্যাদাবান ব্যক্তিকে আশ্রয় দিলে তার উদ্দেশ্যে এরূপ প্রশংসাসূচক বাক্য বলা হ’ত। যেমন বলেছিলেন সে সময় মক্কার নিম্নভূমি অঞ্চলের নেতা ইবনুদ দুগুন্না  গোপনে হাবশায় গমনরত আবুবকর (রাঃ)-কে আশ্রয় দিয়ে ফেরাবার সময় (ইবনু হিশাম ১/৩৭৩)।
অতঃপর খাদীজা স্বামীকে সাথে নিয়ে চাচাতো ভাই অরাক্কা বিন নওফালের কাছে গেলেন। যিনি ইনজীল কিতাবের পন্ডিত ছিলেন এবং ঐ সময় বার্ধক্যে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সব কথা শুনে বললেন, এ তো  সেই ফেরেশতা যাকে আল্লাহ মূসার প্রতি নাযিল করেছিলেন। হায়! যদি আমি সেদিন তরুণ থাকতাম। হায়! যদি আমি সেদিন জীবিত থাকতাম, যেদিন তোমার কওম তোমাকে বহিষ্কার করবে’। একথা শুনে চমকে উঠে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “ওরা কি আমাকে বের করে দিবে’? অরাক্কা বললেন, হ্যাঁ! তুমি যা নিয়ে আগমন করেছ, তা নিয়ে ইতিপূর্বে এমন কেউ আগমন করেননি, যার সাথে শত্রুতা করা হয়নি’। অতঃপর অরাকা তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যদি তোমার সেই দিন আমি পাই, তবে আমি তোমাকে সাধ্যমত সাহায্য করব’।
অহি ও ইলহাম
‘অহি’ )( অর্থ প্রত্যাদেশ এবং ‘ইলহাম’ ) ( অর্থ প্রক্ষেপণ। ‘অহি’ আল্লাহর পক্ষ হাতে নবীগণের নিকটে হয়ে থাকে। পক্ষান্তরে ‘ইলহাম’ আল্লাহর পক্ষ থেকে যেকোন ব্যক্তির প্রতি হ’তে পারে। আল্লাহ মানুষের অন্তরে ভাল-মন্দ দু’টিই ‘ইলহাম’ করে থাকেন (আশ-শামস ৯১/৮)। আভিধানিক অর্থে ‘অহি’ অনেক সময় ‘ইলহাম’ অর্থে আসে। যেমন মূসার মা, খিযির, ঈসার মা ও নানী প্রমুখ নির্বাচিত বান্দাদের প্রতি আল্লাহ অহি করেছেন, যা কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু তা নবুঅতের অহি ছিলনা। অনুরূপভাবে জিন বা মানুষরূপী শয়তান যখন পরস্পরকে চাকচিক্যপূর্ণ যুক্তি দিয়ে পথভ্রষ্ট করে, ওটাকেও কুরআনে ‘অহি’ বলা হয়েছে (আন’আম ৬/১১২) আভিধানিক অর্থে। তবে পারিভাষিক অর্থে ‘অহি’ বলতে কেবল তাকেই বলা হয়, যা মানবজাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহ তাঁর মনোনীত নবীগণের নিকট ফেরেশতা জিব্রীলের মাধ্যমে প্রেরণ করে থাকেন (বাক্বারাহ ২/৯৭)।
উল্লেখ্য যে, ইলহাম ও অহি এক নয়। প্রথমটি যেকোন ব্যক্তির মধ্যে হ’তে পারে। কিন্তু অহি কেবল নবী-রাসূলদের নিকট আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়ে থাকে। নবী হওয়ার জন্য আধ্যাত্মিকতা শর্ত নয়। বরং আল্লাহর মনোনয়ন শর্ত। যদিও নবীগণ আধ্যাত্মিকতার সর্বোচ্চ নমুনা হয়ে থাকেন। অন্যদের আধ্যাত্মিকতায় শয়তানী খোশ-খেয়াল সম্পৃক্ত হ’তে পারে। যেমন বহু কাফের-মুশরিক যোগী-সন্ন্যাসীদের মধ্যে দেখা যায়।
এখানে এসে অনেক ইসলামী চিন্তাবিদের পদস্খলন ঘটে গেছে। তাঁরা ইলহাম ও অহীকে একত্রে গুলিয়ে ফেলেছেন। যেমন মাওলানা আব্দুর রহীম (১৯১৮-১৯৮৭ খৃ.) বলেন, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার অনেকাংশেই এক ধরনের ‘ইলহাম’-এর সাহায্যে হয়ে থাকে। এ ইলহাম বা অহীরই বাস্তবতা আমরা দেখতে পাই সেইসব লোকের জীবনেও, যাঁদের আমরা বলি নবী ও রাসূল।… বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) -এর প্রতি বিশ্বলোক ও বিশ্ব মানবতার সমস্যার সঠিক সমাধান অনুরূপ পদ্ধতিতে ও আকস্মিকভাবে মক্কার এক পর্বত গুহায় উদ্ঘাটিত হয়ে পড়ে। তাঁকে নির্দেশ করা হয় ‘পড় তোমার সেই রবের নামে …। এই দু’টি ক্ষেত্রের জন্যই সেই একই মহাসত্যের নিকট থেকে ‘হঠাৎ আলোর ঝলকানি’ আসার এ ঘটনাবলী অত্যন্ত বিস্ময়কর হ’লেও এতে পারস্পরিক বৈপরিত্য বলতে কিছুই নেই’।
আমরা বলব, এ যুগের আইনস্টাইন বলে খ্যাত স্টিফেন হকিং (জন্ম ১৯৪২)  যিনি বলেন, ঈশ্বর ও পরকাল বলে কিছু নেই, তিনিও কি তাহ’লে আল্লাহর অহী পেয়ে এগুলো বলছেন, নাকি শয়তানের ধোঁকায় পড়ে এগুলি বলছেন? নিঃসন্দেহে বিজ্ঞানী ও নবী কখনোই এক নন। আধ্যাত্মিক ব্যক্তি ও চিন্তাবিদ মানুষ চিরকাল থাকবেন। কিন্তু তারা কখনোই নবী হবেন না। আর নবুঅতের সিলসিলা শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) পর্যন্ত এসে সমাপ্ত হয়ে গেছে।
দাওয়াতী জীবন
নবীদের দাওয়াতকে গোপনে ও প্রকাশ্যে দু’ভাগে ভাগ করার কোন সুযোগ নেই। কেননা তাঁরা নিজ সম্প্রদায়ের নিকট প্রকাশ্যভাবেই নবুঅতের দাবী নিয়ে দাওয়াত শুরু করেন। প্রত্যেক নবীই তার কওমকে বলেছেন, ‘হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই’। আমাদের নবীও বলেছেন, ‘হে মানবজাতি! আমি তোমাদের সকলের প্রতি আল্লাহর প্রেরিত রাসূল..’ (আ’রাফ ৭/১৫৮)। তবে এটাই স্বাভাবিক যে, আপনজনদের নিকটেই প্রথমে দাওয়াত দেওয়া হয়। আর এই দাওয়াত স্থান-কাল-পাত্রভেদে কখনো গোপনে কখনো প্রকাশ্যে কখনো সর্বসমক্ষে হয়ে থাকে। ইবনু ইসহাক বিনা সনদে উল্লেখ করেন, তার নিকটে এই মর্মে খবর পৌঁছেছে যে, আল্লাহ তাকে প্রকাশ্যে দাওয়াত দেওয়ার নির্দেশ দানের আগ পর্যন্ত রাসূল (সাঃ) তিন বছর গোপনে দাওয়াত দিয়েছেন’ (ইবনু হিশাম ১/২৬২)। ইবনু সা’দ এবং ওয়াক্বেদীও সে কথা বলেছেন। বালাযুরী এটাকে চার বছর বলেছেন। অনেক জীবনীকার এই মেয়াদের উপর ভিত্তি করে শেষনবী (সাঃ) -এর দাওয়াতের মেয়াদ নির্দিষ্ট করেছেন। অথচ দাওয়াতের এইরূপ সীমা নির্ধারণ করার কোন দলীল নেই’ (মা শা-‘আ ২৯ পৃঃ)।
যেকোন সংস্কার আন্দোলন শুরু করতে গেলে প্রথমে তা গোপনেই শুরু করতে হয়। পুরা সমাজ যেখানে ভোগবাদিতায় ডুবে আছে, সেখানে ভোগলিপ্সাহীন আখেরাতভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দাওয়াত নিয়ে অগ্রসর হওয়া সাগরের স্রোত পরিবর্তনের ন্যায় কঠিন কাজ। এ পথের দিশা দেওয়া এবং এ পথে মানুষকে ফিরিয়ে আনা দু’টিই কঠিন বিষয় । রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেকাজের জন্যই আদিষ্ট হয়েছিলেন। অহী প্রাপ্ত হওয়ার পরেই খাদীজার সাথে তিনি সে সময়ে মক্কার বয়োবৃদ্ধ সেরা বিদ্বান অরাক্কা বিন নওফাল-এর কাছে যান। তিনি সবকিছু অবগত হওয়ার পর তাঁকে ভবিষ্যৎ বিরোধিতা ও আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সাবধান করে দেন। ফলে তিনি প্রথমে গোপনে দাওয়াত শুরু করেন। যদিও খাদীজা, আলী, আবুবকর, ওছমান প্রমুখদের মত মক্কার সেরা ও প্রসিদ্ধ ব্যক্তিগণের ইসলাম কবুলের পর এই দাওয়াত আদৌ গোপন থাকেনি।
প্রাথমিক মুসলমানগণ
প্রথমেই তাঁর দাওয়াত কবুল করেন মহিলাদের মধ্যে তাঁর পুণ্যশীলা স্ত্রী খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ (রাঃ)। অতঃপর গোলামদের মধ্যে তাঁর মুক্তদাস যায়েদ বিন হারেছাহ, শিশু-কিশোরদের মধ্যে আলী ইবনু আবী তালিব এবং বয়স্কদের মধ্যে নিকটতম বন্ধু আবুবকর ইবনু আবী কুহাফাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।
অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর দাওয়াতে ইসলাম কবুল করেন একে একে ওছমান, যুবায়ের, আব্দুর রহমান বিন আওফ, সাদ বিন আবু ওয়াক্কাছ ও তালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। এছাড়া আবুবকরের স্ত্রী উম্মে রূমান ও মা বার্রাহ এবং দুই মেয়ে আসমা ও আয়েশা। এছাড়া আবুবকর (রাঃ) কর্তৃক ৭ জন মুক্তদাস-দাসী হ’লেন, ‘আমের বিন ফুহাইরা, উম্মে উবাইস, যিন্নীরাহ, নাহদিয়াহ ও তার মেয়ে এবং বনু মুআম্মাল-এর জনৈকা দাসী এবং বেলাল বিন রাবাহ ।
অতঃপর একে একে ইসলাম কবুল করেন আবু ওবায়দাহ ইবনুল জারাহ, আবু সালামাহ, আরক্বাম, ওছমান বিন মাযউন ও তাঁর দুই ভাই কুদামাহ ও আব্দুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহ বিন হারেছ, সাঈদ বিন যায়েদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিন খাত্ত্বাব (ওমরের বোন), খাববার ইবনুল আরাত, ওমায়ের বিন আবু ওয়াক্কাছ, আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ, মাসউদ বিন রাবী’আহ আল-ক্বারী, সালীত্ব বিন আমর ও তাঁর ভাই হাতেব বিন আমর, ‘আইয়াশ বিন আবু রাবী’আহ ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে সালামাহ, খুনাইস বিন হুযাফাহ, ‘আমের বিন রবীআহ, আব্দুল্লাহ বিন জাহশ, জাফর বিন আবু তালিব ও তাঁর স্ত্রী আসমা বিনতে উমায়েস, নুআইম বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল আছ ও তাঁর স্ত্রী উমাইনাহ বিনতে খালাফ, হাতেব বিন আমর, আবু হুযায়ফা বিন উবা, ওয়াক্কিদ বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন বুকায়ের ও তার ভাইগণ ‘আমের, আক্কিল ও ইয়াস, ‘আম্মার, পিতা ইয়াসির ও মাতা সুমাইয়া, ছুহায়েব রূমী, আমর বিন আবাসাহ, মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদ, ‘আফীফ বিন ক্বায়েস।
খাদীজা (রাঃ)-এর পরে রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা আবাস-এর স্ত্রী উম্মুল ফযল ও তাঁর গোলাম আবু রাফে’ ইসলাম কবুল করেন। ইবনু ইসহাকের বর্ণনা মতে প্রথম তিন বছরে উপরোক্ত ব্যক্তিগণ ইসলাম গ্রহণের পর মক্কায় ইসলাম প্রকাশ্য হয়ে পড়ে ও তা নিয়ে লোকদের মধ্যে আলোচনা হ’তে থাকে’।
উপরে যাদের নামের তালিকা দেওয়া হ’ল, তারা কুরায়েশ বংশের প্রায় সকল শাখা-প্রশাখার সাথে সরাসরি কিংবা আত্মীয়তাসূত্রে যুক্ত ছিলেন। কুরায়েশ নেতাদের কাছে এঁদের খবর পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তারা এটাকে স্রেফ ব্যক্তিগত ধর্মাচার মনে করেছিলেন।  ফলে তাদের অনেকেই কুরায়েশ নেতাদের হাতে চরমভাবে নির্যাতিত হন।
ছালাতের নির্দেশনা
যেকোন সংস্কার আন্দোলনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন আক্বীদার মযবুতী। আর এই মযবুতীর জন্য চাই নিয়মিত আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ। যা সর্বদা সংস্কারককে তার আদর্শমূলে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে। সেকারণ অধ্যাত্ম সাধনার প্রাথমিক কাজ হিসাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে নবুঅতের শুরু থেকেই সকাল ও সন্ধ্যায় দু’বার ছালাত আদায়ের নির্দেশনা দান করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন,, তুমি তোমার প্রভুর প্রশংসা জ্ঞাপন কর সন্ধ্যায় ও সকালে’ (মুমিন/গাফের ৪০/৫৫)।
প্রথম কুরআন নাযিলের পর জিব্রীলের মাধ্যমে তিনি ওযূ ও ছালাত শিখেন।হিজরতের স্বল্পকাল পূর্বে মে’রাজ সংঘটিত হবার আগ পর্যন্ত ফজরের দু’রাক’আত ও আছরের দু’রাক’আত করে ছালাত আদায়ের নিয়ম জারী থাকে। আয়েশা (রাঃ) বলেন, শুরুতে ছালাত বাড়ীতে ও সফরে ছিল দু’ দু’ রাকআত করে। এছাড়া রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ‘অতিরিক্ত’)  ছিল তাহাজ্জুদের ছালাত (ইসরা/বনু ইস্রাঈল ১৭/৭৯)। সেই সাথে ছাহাবীগণও নিয়মিতভাবে রাত্রির নফল ছালাত আদায় করতেন।অতঃপর মি’রাজের রাত্রিতে নিয়মিতভাবে দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করা হয়।উল্লেখ্য যে, পূর্বেকার সকল নবীর সময়ে ছালাত, ছিয়াম ও যাকাত ফরয ছিল। তবে সেসবের ধরন ও পদ্ধতি ছিল কিছুটা পৃথক
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও তাঁর সাথীগণ প্রথম দিকে গোপনে এই ছালাত আদায় করতেন এবং লোকদেরকে গাছ, পাথর, চন্দ্র, সূর্য ইত্যাদির উপাসনা পরিত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদত শিক্ষা দিতেন। তিনি কখনো কখনো সাথীদের নিয়ে পাহাড়ের গুহাতে গোপনে ছালাত আদায় করতেন। একদিন আবু ত্বালিব স্বীয় পুত্র আলী ও ভাতিজা মুহাম্মাদকে এটা আদায় করতে দেখে কারণ জিজ্ঞেস করেন। সবকিছু শুনে বিষয়টির আধ্যাত্মিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি তাদেরকে উৎসাহিত করেন।
উর্দু কবি বলেন,
‘বায়ু প্রবাহ ফিরানো কঠিন, স্রোতকে উল্টানো কঠিন’। কিন্তু অত কঠিন নয়, যত না কঠিন একটা পথভ্রষ্ট জাতিকে সুপথে ফিরিয়ে আনা’।
সমাজনেতাদের প্রতিক্রিয়া
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর আহবানের সত্যতা ও যথার্থতার বিষয়ে সমাজনেতাদের মধ্যে কোনরূপ দ্বিমত ছিল না। কিন্তু ধুরন্ধর নেতারা তাওহীদের এ অমর আহবানের মধ্যে তাদের দুনিয়াবী স্বার্থের নিশ্চিত অপমৃত্যু দেখতে পেয়েছিল। এক আল্লাহকে মেনে নিলে শিরক বিলুপ্ত হবে। দেব-দেবীর পূজা বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সারা আরবের উপর তাদের ধর্মীয় নেতৃত্ব ও পৌরহিত্যের মর্যাদা শেষ হয়ে যাবে। এছাড়া লোকেরা যে পূজার অর্ঘ্য সেখানে নিবেদন করে, তা ভোগ করা থেকে তারা বঞ্চিত হবে। আল্লাহর বিধানকে মানতে গেলে তাদের মনগড়া সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিধানসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। ঘরে বসে দাদন ব্যবসার মাধ্যমে চক্রবৃদ্ধি হারে সূদ নিয়ে তারা যেভাবে জোঁকের মত গরীবের রক্ত শোষণ করছিল, তা বন্ধ হয়ে যাবে। যে নারীকে তারা কেবল ভোগের সামগ্রী হিসাবে মনে করে, তাকে পূর্ণ সম্মানে অধিষ্ঠিত করতে হবে। এমনকি তাকে নিজ কষ্টার্জিত সম্পত্তির উত্তরাধিকার দিতে হবে। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের ‘ভাই’ হিসাবে সমান ভাবতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা যুগ যুগ ধরে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্ব তারা দিয়ে আসছিল, তা নিমেষে হারিয়ে যাবে এবং মুহাম্মাদকে নবী মেনে নিলে কেবল তারই আনুগত্য করতে হবে। অতএব মুহাম্মাদ দিন-রাত কা’বাগৃহে বসে ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকুক, আমরাও তার সাথী হাতে রাযী আছি। কিন্তু তাওহীদের সাম্য ও মৈত্রীর আহবান আমরা কোনমতেই মানতে রাযী নই। এইভাবে প্রধানতঃ সামাজিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের বিপরীত ধারণা করেই তারা রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। আল্লাহ বলেন,  ‘তারা যেসব কথা বলে তা যে তোমাকে খুবই কষ্ট দেয়, তা আমরা জানি। তবে ওরা তোমাকে মিথ্যাবাদী বলে না। বরং যালেমরা আল্লাহর আয়াত সমূহকে অস্বীকার করে’ (আন’আম ৬/৩৩)। যুগে যুগে সকল নবী-রাসূল ও তাঁদের সনিষ্ঠ অনুসারীদের একই অবস্থার সম্মুখীন হ’তে হয়েছে এবং হবে।
সম্প্রদায়ের নেতাদের মন্দ প্রতিক্রিয়ার অন্যতম কারণ ছিল গোত্রীয় হিংসা এবং ভালোর প্রতি হিংসা। যেমন অন্যতম নেতা আখনাস বিন শারীঙ্ক-এর প্রশ্নের উত্তরে আৰু জাহু বলেছিলেন, বনু আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে ।… তারা বলবে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে অহি’ আসে। আমরা কিভাবে ঐ মর্যাদায় পৌঁছব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপর ঈমান আনব না বা তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ছিলেন আব্দে মানাফের পুত্র হাশেম-এর বংশধর। পক্ষান্তরে আবু জাহল ছিলেন বহু মাখযূম গোত্রের। বনু হাশেম গোত্রে নবীর আবির্ভাব হওয়ায় বনু মাখযুম গোত্র তাদের প্রতি হিংসা পরায়ণ ছিল। যদিও সকলে ছিলেন কুরায়েশ বংশীয়।
উর্দু কবি হালী এই সময়কার অবস্থা বর্ণনা করেন নিম্নোক্ত ভাষায়
(১) এটি বজ্রের ধ্বনি ছিল, না পথ প্রদর্শকের কণ্ঠ ছিল, আরবের সমগ্র যমীন যা কাঁপিয়ে দিল। (২) নতুন এক বন্ধন সকলের অন্তরে লাগিয়ে দিল, এক আওয়াযেই ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে দিল। (৩) সত্যের এ আহবানে সর্বত্র হৈ চৈ পড়ে গেল, সত্যের নামে ময়দান ও পাহাড় সর্বত্র গুঞ্জরিত হ’ল” (মুসাদ্দাসে হালী – উর্দূ ষষ্ঠপদী, ১৪ পৃঃ)।
হজ্জের মৌসুমে রাসূল (ছাঃ)-এর দাওয়াত
যথাসময়ে হজ্জের মৌসুম এসে গেল। হজ্জের মাসের আগে-পিছে দু’মাস হ’ল হারামের মাস। এ তিন মাস মারামারি-কাটাকাটি নিষিদ্ধ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হজ্জে আগত মেহমানদের তাঁবুতে গিয়ে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। ওদিকে অলীদের পরামর্শ মতে আবু লাহাবের নেতৃত্বে পরিচালিত গীবতকারী দল সবার কাছে গিয়ে রাসূল (সাঃ) সম্পর্কে বিভিন্ন অপবাদ প্রচার করতে থাকে এবং শেষে বলে আসে যে, সে একজন জাদুকর। তার কথা শুনলেই জাদুগ্রস্ত হয়ে যেতে হবে। অতএব কেউ যেন তার ধারে কাছে না যায়। খোদ আৰু লাহাব নির্লজ্জের মত রাসূল (সাঃ)-এর পিছে পিছে ঘুরতে লাগল। রাসূল (ছাঃ) যেখানেই যান, সেখানেই সে গিয়ে বলে হে জনগণ! তোমরা এর কথা শুনো না। সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যুক’।শুধু তাই নয়, সে উপরোক্ত গালি দিয়ে হজ্জ মৌসুমের বাইরে যুল-মাজায বাজারে রাসূল (সাঃ)-এর পায়ে পাথর ছুঁড়ে মেরেছিল। যাতে তাঁর দু’গোড়ালী রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল।
যুগে যুগে বাতিলপন্থীরা এভাবে হকপন্থীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ রটনা করেছে। আজও করে যাচ্ছে। যাতে লোকেরা হক কবুল করা হ’তে বিরত থাকে।
অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য কৌশল সমূহ /  নানাবিধ অপবাদ রটনা
হজ্জের মৌসুম শেষে নেতারা পুনরায় হিসাব-নিকাশে বসে গেলেন। দেখা গেল যে, অপবাদ রটনায় কাজ হয়েছে সবচেয়ে বেশী। এর দ্বারা যেমন প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করা যায়। তেমনি সাধারণ মানুষ দ্রুত সেটা লুফে নেয়। কেউ যাচাই-বাছাই করতে চাইলে তো আমাদের কাছেই আসবে। কেননা আমরাই সমাজের নেতা এবং আমরাই তার নিকটতম আত্মীয় ও প্রতিবেশী। অতএব আমরাই যখন তার বিরুদ্ধে বলছি, তখন কেউ আর এ পথ মাড়াবে না। অতএব অপবাদের সংখ্যা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। ফলে রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে তারা অনেকগুলি অপবাদ তৈরী করল। যেমন
তিনি (১) পাগল (২) কবি, তারা বলল, আমরা কি একজন কবি ও পাগলের জন্য আমাদের উপাস্যদের পরিত্যাগ করব? (ছাফফাত ৩৭/৩৬)। (৩) জাদুকর (৪) মহা মিথ্যাবাদী এ কাফেররা বলল, এ লোকটি একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী’ (ছোয়াদ ৩৮/৪)। (৫) পুরাকালের উপাখ্যান বর্ণনাকারী ১১ এটা পূর্ববর্তীদের মিথ্যা উপাখ্যান ব্যতীত কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)। (৬) অন্যের সাহায্যে মিথ্যা রচনাকারী :  তারা বলে যে, তাকে শিক্ষা দেয় একজন মানুষ’ (নাহল ১৬/১০৩), (৭) মিথ্যা রটনাকারী কাফেররা বলে, এটা বানোয়াট ছাড়া কিছুই নয় যা সে উদ্ভাবন করেছে এবং অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরা তাকে এব্যাপারে সাহায্য করেছে’ (ফুরক্বান ২৫/৪)। (৮) গণৎকার  খুব কম এবং অতএব তুমি উপদেশ দিতে থাকো। তোমার প্রতিপালকের অনুগ্রহে তুমি গণক নও, উন্মাদও নও’ (তূর ৫২/২৯)। (১) ইনি তো সাধারণ মানুষ, ফেরেশতা নন ।  তারা বলে যে, এ কেমন রাসূল যে খাদ্য ভক্ষণ করে ও হাট-বাজারে চলাফেরা করে? তার প্রতি কেন ফেরেশতা নাযিল করা হলো না, যে তার সাথে থাকতো সদা সতর্ককারী রূপে? (ফুরকান ২৫/৭)। (১০) পথভ্রষ্ট। যখন তারা ঈমানদারগণকে দেখত, তখন বলত, নিশ্চয়ই এরা পথভ্রষ্ট’ (মুত্বাফফেফীন ৮৩/৩২)। (১১) ধর্মত্যাগী আবু লাহাব বলত, তোমরা এর আনুগত্য করো না। কেননা সে ধর্মত্যাগী মহা মিথ্যাবাদী’ (আহমাদ)। (১২) পিতৃধর্ম বিনষ্টকারী (১৩) জামা’আত বিভক্তকারী (ইবনু হিশাম ১/২৯৫) (১৪) জাদুগ্রস্ত, যালেমরা বলে, তোমরা তো কেবল একজন জাদুগ্রস্ত ব্যক্তির অনুসরণ করছ’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৭)। (১৫) ‘মুযাম্মাম’। আবু লাহাবের স্ত্রী উম্মে জামীল ‘মুহাম্মাদ’ (প্রশংসিত) নামের বিপরীতে ‘মুযাম্মাম’ (নিন্দিত) নামে ব্যঙ্গ কবিতা বলত (ইবনু হিশাম ১/৩৫৬)। (১৬) রা‘এনা। মদীনায় হিজরত করার পর সেখানকার দুরাচার ইহুদীরা রাসূল (ছাঃ)-কে ‘রা’ এনা’  বলে ডাকত (বাক্বারাহ ২/১০৪)। তাদের মাতৃভাষা হিব্রুতে যার অর্থ ছিল এস, আমাদের মন্দ লোকটি’।
এইসব অপবাদের জওয়াবে আল্লাহ বলেন, এর দেখ ওরা কিভাবে তোমার নামে (বাজে) উপমাসমূহ প্রদান করছে। ওরা পথভ্রষ্ট হয়েছে। অতএব ওরা আর পথ পেতে সক্ষম হবে না’ (বনু ইস্রাঈল ১৭/৪৮; ফুরকান ২৫/১)। কুৎসা রটনাকারীদের বিরুদ্ধে যুগে যুগে এটাই হ’ল সর্বোত্তম জবাব।
চাঁদ দ্বিখন্ডিত করণের প্রস্তাব
সবকিছুতে ব্যর্থ হয়ে সবশেষে ইহুদী পন্ডিতেরা কুরায়েশ নেতাদের একটা বিস্ময়কর কৌশল শিখিয়ে দিল। তারা বলল, মুহাম্মাদ জাদুকর কি-না, যাচাইয়ের একটা প্রকৃষ্ট পন্থা এই যে, জাদুর প্রভাব কেবল যমীনেই সীমাবদ্ধ থাকে। আসমানে এর কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। অতএব তোমরা মুহাম্মাদকে বল, সে চাঁদকে দ্বিখন্ডিত করুক। সম্ভবতঃ হযরত মূসা (আঃ) কর্তৃক লাঠির সাহায্যে নদী বিভক্ত হওয়ার মু’জেযা থেকেই চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করার চিন্তাটি ইহুদীদের মাথায় এসে থাকবে। অথচ নদী বিভক্ত করার চাইতে চন্দ্ৰ দ্বিখন্ডিত করা কতই না কঠিন বিষয়। কেননা এটি দুনিয়ার এবং অন্যটি আকাশের। কুরায়েশ নেতারা মহা খুশীতে বাগবাগ হয়ে গেল এই ভেবে যে, এবার নির্ঘাত মুহাম্মাদ কুপোকাৎ হবে। তারা দল বেঁধে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে এক চন্দ্রোজ্জ্বল রাত্রিতে উক্ত প্রশ্ন করল। ঐ সময় সেখানে হযরত আলী, আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ, জুবায়ের ইবনু মুত্ব’ইম প্রমুখ ছাহাবীগণ উপস্থিত ছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু ছাহাবী উক্ত বিষয়ে হাদীছ বর্ণনা করেছেন। যে কারণে হাফ্যে ইবনু কাছীর এতদসংক্রান্ত হাদীছসমূহকে ‘মুতাওয়াতির’ পর্যায়ভুক্ত বলেছেন (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা কামার)।
কুরায়েশ নেতাদের দাবী মোতাবেক আল্লাহর হুকুমে রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত মু’জেযা প্রদর্শিত হ’ল। মুহূর্তের মধ্যে চাঁদ দ্বিখন্ডিত হয়ে পূর্ব ও পশ্চিমে ছিটকে পড়ল। উভয় টুকরার মাঝখানে ‘হেরা’ পর্বত আড়াল হয়ে গেল। অতঃপর পুনরায় দুই টুকরা এসে যুক্ত হ’ল। এ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিনা-তে ছিলেন। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) কর্তৃক
ছহীহায়নের বর্ণনায় এসেছে যে, এরপর রাসূল (সাঃ) উপস্থিত নেতাদের বললেন, ‘তোমরা সাক্ষী থাক’।ইবনু মাস’উদ ও ইবনু ওমর (রাঃ) কর্তৃক ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ঐসময় আল্লাহকে সাক্ষী রেখে রাসূল (সাঃ) বলেন, ৮। হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক  এতে অনুমিত হয় যে, ইবনু মাসউদ (রাঃ)-এর সাথে ঐ সময় ইবনু ওমর (রাঃ) হাযির ছিলেন এবং উভয়ে উক্ত ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ১৩ বছরের মত। ঘটনাটি ১ম নববী বর্ষে ঘটে। উক্ত ঘটনার প্রেক্ষিতে সূরা ক্বামার নাযিল হয়। যার শুরু হ’ল all ক্বিয়ামত আসন্ন। চন্দ্র বিদীর্ণ হয়েছে (কামার ৫৪/১)।
এত বড় ঘটনা চাক্ষুষ দেখা সত্ত্বেও কুরায়েশ নেতারা ঈমান আনলেন না। পরে বিভিন্ন এলাকা হ’তে আগত লোকদের কাছেও তারা একই ঘটনা শোনেন। ইবনু মাসউদ বলেন, তারা বললেন, এটা আবু কাবশার পুত্রের (মুহাম্মাদের) জাদু। সে তোমাদের জাদু করেছে। অতএব তোমরা বহিরাগত লোকদের জিজ্ঞেস কর। কেননা মুহাম্মাদ একসঙ্গে সবাইকে জাদু করতে পারবে না। অতএব বহিরাগতরা বললে সেটাই ঠিক। নইলে এটা স্রেফ জাদু মাত্র। অতঃপর চারদিক থেকে আসা মুসাফিরদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা সবাই এ দৃশ্য দেখেছেন বলে সাক্ষ্য দেন’। কিন্তু যিদ ও অহংকার তাদেরকে ঈমান আনা হ’তে বিরত রাখলো। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,  তারা যদি কোন নিদর্শন (যেমন চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ) দেখে, তবে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং বলে যে, এটা তো চলমান জাদু’। ‘তারা মিথ্যারোপ করে এবং নিজেদের খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে। অথচ প্রত্যেক কাজের ফলাফল (ক্বিয়ামতের দিন) স্থিরীকৃত হবে (কামার ৫৪/২-৩)।
তারীখে ফিরিশতায় বর্ণিত হয়েছে যে, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়ার এই দৃশ্য ভারতের মালাবারের জনৈক মহারাজা স্বচক্ষে দেখেন এবং তা নিজের রোজনামচায় লিপিবদ্ধ করেন। পরে আরব বণিকদের মুখে ঘটনা শুনে তখনকার রাজা ‘সামেরী’ উড় রোজনামচা বের করেন। অতঃপর তাতে ঘটনার সত্যতা দেখে তিনি মুসলমান হয়ে যান। যদিও সামরিক নেতা ও সমাজনেতাদের ভয়ে তিনি ইসলাম গোপন রাখেন’। ১৯৬৯ সালের ২০শে জুলাই চন্দ্রে প্রথম পদাপর্ণকারী দলের নেতা নেইল আর্মস্ট্রং স্বচক্ষে চন্দ্রপৃষ্ঠের বিভক্তি রেখা দেখে বিস্ময়াভিভূত হন এবং ইসলাম কবুল করেন। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ভয়ে তিনি একথা কয়েক বছর পরে প্রকাশ করেন।
চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করা ছাড়াও রাসূল (সাঃ) -এর জীবনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মু’জেযা প্রদর্শিত হয়েছে। কিন্তু এগুলি ছিল কেবল হঠকারীদের অহংকার চূর্ণ করার জন্য। এর দ্বারা তারা কখনোই হেদায়াত লাভ করেনি। যদিও এর ফলে দ্বীনদারগণের ঈমান বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর নানামুখী অত্যাচার – . ঠাট্টা-বিদ্রুপ করা
সমস্ত যুক্তি, কৌশল ও আপোষ প্রস্তাব ব্যর্থ হওয়ার পর কুরায়েশ নেতারা এবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে সরাসরি অত্যাচারের সিদ্ধান্ত নিল। যেমন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দিক থেকে লোকদের ফিরিয়ে আনার জন্য কুরায়েশ নেতারা বিদ্রুপ করে বলে, আমরাও এরূপ বলতে পারি। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, যখন তাদের নিকটে আমাদের আয়াত সমূহ পাঠ করা হয়, তখন তারা বলে, আমরা শুনেছি। ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি। এসব তো পূর্ববর্তীদের উপকথা ভিন্ন কিছুই নয়’ (আনফাল ৮/৩১)।
উক্ত আয়াতে কাফেররা কুরআনকে পুরাকালের কাহিনী এবং ইচ্ছা করলে আমরাও এরূপ বলতে পারি’ বলে দম্ভ প্রকাশ করেছে। অথচ অনুরূপ একটি কুরআন বা তার মত দু’একটি সূরা বা আয়াত জিন-ইনসান সকলকে একত্রিত হয়ে রচনা করে আনার জন্য মক্কায় পাঁচবার এবং মদীনায় একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) সহ মোট ছয়বার কাফেরদের চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কিন্তু সে যুগে ও এ যুগে কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বরং দেখা গেছে যে, সে যুগে ঐসব নেতারাই গোপনে রাতের অন্ধকারে বাইরে দাঁড়িয়ে তাহাজ্জুদের ছালাতে রাসূল (সাঃ)-এর কুরআন তেলাওয়াত শুনত। আবু সুফিয়ান, নযর বিন হারেছ, আখনাস বিন শারীক্ব, আবু জাহল প্রমুখ নেতারা একে অপরকে না জানিয়ে গোপনে একাজ করত’ (ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬)। কিন্তু যখন তারা তাদের জনগণের সামনে যেত, তখন তাদের মন্তব্য পাল্টে যেত। কারণ তখন দুনিয়াবী স্বার্থ তাদেরকে সত্যভাষণ থেকে ফিরিয়ে রাখত। একই অবস্থা আজকালকের মুসলিম-অমুসলিম নেতাদের। যাদের অধিকাংশ রাসূল (সাঃ) ও কুরআনের সত্যতাকে স্বীকার করে। কিন্তু বাস্তবে তা মানতে রাযী হয় না স্রেফ দুনিয়াবী স্বার্থের কারণে।
এভাবে কাফেররা তাঁকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগ পর্যন্ত নানারূপ মানসিক কষ্ট দেয়। এ সময় আল্লাহ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘তারা যেসব কথা বলে, তাতে তুমি ছবর কর এবং তাদেরকে সুন্দরভাবে পরিহার করে চল’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১০)। তিনি আরও বলেন, একাত্তর ‘বিদ্রূপকারীদের বিরুদ্ধে আমরাই তোমার জন্য যথেষ্ট’ (হিজর ১৫/৯৫)।
প্রতিবেশীদের অত্যাচার
রাসুলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকটতম প্রতিবেশী ছিলেন তাঁর চাচা আবু লাহাব। তিনি ও তার স্ত্রী ছাড়াও কষ্টদানকারী অন্যান্য প্রতিবেশী ছিল হাকাম বিন আবুল ‘আছ বিন উমাইয়া, উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্ব, ‘আদী বিন হামরা ছাক্বাফী, ইবনুল আছদা আল-হু্যালী। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেবল হাকাম বিন আবুল আছ বিন উমাইয়া ইসলাম কবুল করেছিলেন (ইবনু হিশাম ১/৪১৫-১৬)। ইনিই ছিলেন উমাইয়া বংশের অন্যতম খলীফা মারওয়ানের পিতা। বস্তুতঃ মুআবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদ বাদে মারওয়ানের বংশধরগণই ছিলেন উমাইয়া খেলাফতের পরপর খলীফা। অন্যান্য প্রতিবেশীরাও রাসূল (ছাঃ)-এর উপর নানাবিধ অত্যাচার চালায়। তাতে সান্ত্বনা দিয়ে আল্লাহ বলেন, ‘তোমার পূর্বের বহু রাসূলকে মিথ্যা বলা হয়েছে। কিন্তু এ মিথ্যারোপে তারা ছবর وا করেছেন এবং তারা নির্যাতিত হয়েছেন যতক্ষণ না তাদের কাছে আমাদের সাহায্য এসে পৌঁছেছে। আর আল্লাহর বাণীসমূহের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। এ বিষয়ে নবীগণের কিছু খবর তোমার নিকটে পৌঁছে গেছে (যার মধ্যে তোমার জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে)’ (আন’আম ৬/৩৪)
কা’বাগৃহে ছালাতরত অবস্থায় কষ্টদান
(ক) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন যে, একদিন রাসূল (সাঃ) বায়তুল্লাহ্ পাশে ছালাত আদায় করছিলেন। এমন সময় আবু জাহল ও তার সাথীরা অদূরে বসে বলাবলি করতে লাগল, কে উটের নাড়ি-ভুঁড়ি এনে এই ব্যক্তির উপর চাপাতে পারে, যখন সে সিজদায় যাবে? তখন ওকবা বিন আবী মু’আইত উটের ভুঁড়ি এনে সিজদারত রাসূলের দুই কাঁধের মাঝখানে চাপিয়ে দিল, যাতে ঐ বিরাট ভুড়ির চাপে ও দুর্গন্ধে দম বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। এতে শত্রুরা হেসে লুটোপুটি খেয়ে একে অপরের উপর গড়িয়ে পড়তে থাকে। ইবনু মাসউদ বলেন, আমি সব দেখছিলাম। কিন্তু এই অবস্থায় আমার কিছুই করার ছিল না। এই সময় ফাতেমার কাছে খবর পৌঁছলে তিনি দৌড়ে এসে ভুঁড়িটি সরিয়ে দিয়ে পিতাকে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেন। ইবনু হাজার বলেন, সম্ভবতঃ খবরটি রাবী নিজেই দিয়েছিলেন (বুখারী ফহসহ হা/৫২০-এর আলোচনা)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মাথা উঁচু করে তিনবার বলেন,
হে আল্লাহ তুমি কুরায়েশকে ধর (তিনবার)! হে আল্লাহ তুমি আমর ইবনে হেশাম (আবু জাহল)-কে ধর। হে আল্লাহ তুমি উবা ও শায়বাহ বিন রাবী আহ্, অলীদ বিন উত্তা, উমাইয়া বিন খালাফ, ওকবা বিন আৰু মু’আইত্ব এবং উমারাহ বিন অলীদকে ধরা। ইবনু মাস উদ বলেন, আমি তাদের (উক্ত ৭ জনের) সবাইকে বদর যুদ্ধে নিহত হয়ে কৃয়ায় নিক্ষিপ্ত অবস্থায় দেখেছি’। উটের ভুঁড়ি চাপানোর এই নির্দেশ আবু জাহলই দিয়েছিলেন এবং অন্যেরা তা মেনে নিয়েছিল। সেমতে তার আগের দিন উটসমূহ নহর করা হয়েছিল।
এর দ্বারা বুঝা যায় যে, নেককার ব্যক্তির দোআ বা বদ দোআ অবশ্যই আল্লাহর নিকটে কবুল হয়। তার বাস্তবায়ন সঙ্গে সঙ্গে হাতে পারে অথবা আল্লাহ তার থেকে অনুরূপ একটি কষ্ট দূর করে দেন অথবা সেটি আখেরাতে প্রদানের জন্য রেখে দেন’ (আহমাদ হা/১১১৪৯)। কিন্তু আখেরাতের জন্য রেখে দেওয়ার কারণে বদকারগণ ঐ বদ দো-আর কোন গুরুত্ব দেয় না। বরং পুনরায় কঠিনভাবে শত্রুতা করতে থাকে। যেমন আবু জাহ্ গং রাসূল (সাঃ) এর বদ দো’আ শুনে ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষণে তা ভুলে যায় এবং বিপুল উৎসাহে শত্রুতা করতে থাকে। ফলে এই ঘটনার প্রায় দশ বছর পর বদর যুদ্ধে তাদের উপরে উক্ত বদ দো’আর বাস্তবায়ন ঘটে ও সব নেতা একত্রে নিহত হয়। আর বদর যুদ্ধের পর এক সপ্তাহের মধ্যে আরেক নেতা আবু লাহাব গুটিবসন্তে আক্রান্ত হয়ে পচে-গলে দুর্গন্ধযুক্ত অবস্থায় মক্কায় নিজ গৃহে মারা যায়। এভাবে মযলূম নবী বিজয়ী হন ও যালেম নেতারা ধ্বংস হয়।
উল্লেখ্য যে, রাবী আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) উক্ত হাদীছে বর্ণিত মুশরিক নেতাদের সবাইকে বদরের যুদ্ধে নিহত হয়ে কুয়ায় নিক্ষিপ্ত হ’তে দেখেছেন’ বলে যে কথা বর্ণনায় এসেছে, তার অর্থ হ’ল তিনি এদের অধিকাংশাকে দেখেছেন। কেননা ওকবা বিন আৰু মু’আইত্ব বদরে যুদ্ধাবস্থায় নিহত হননি। বরং তাকে বন্দী করে মদীনায় নিয়ে যাওয়ার পথে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয়। উমাইয়া বিন খালাফ বদরে নিহত হ’লেও উক্ত কূয়ায় নিক্ষিপ্ত হননি। বরং অধিক স্থূলদেহী হওয়ায় ও ফুলে যাওয়ার কারণে কুয়ায় ফেলা সম্ভব হয়নি। ফলে তাকে কৃয়ার অদূরে একটি গর্তে ফেলে মাটি ও পাথর চাপা দেওয়া হয়।  অতঃপর উমারাহ বিন অলীদ বিন মুগীরাহ মাখযুমী, যাকে কুরায়েশরা দূত হিসাবে বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিল। সেখানে গিয়ে সে জাদুর ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে। অতঃপর হাবশার জঙ্গলে কাফের অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। ঘটনাটি খুবই প্রসিদ্ধ। তখন ছিল দ্বিতীয় খলীফা হযরত ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকাল ।
একদিন ছালাতরত অবস্থায় ওকবা বিন আবু মু’আইত্ব এসে গলায় জোরে কাপড় পেঁচিয়ে ধরল, যাতে রাসূল (সাঃ) নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যান। জনৈক ব্যক্তি চিৎকার করে গিয়ে এ খবর দিলে আবুবকর (রাঃ) ছুটে এসে পেঁচানো কাপড় খুলে দিলেন ও বদমায়েশগুলিকে ধিক্কার দিয়ে বললেন, ‘তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করছ, যিনি বলেন আমার প্রভু আল্লাহ। অথচ তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ এ সময় তারা রাসূল (সাঃ)-কে ছেড়ে আবুবকরকে বেদম প্রহার করে’ (বুখারী, হা/৬৩৭৮, ৪৮১৫)।
ওরওয়া বিন যুবায়ের বলেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল আছ (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলাম, মুশরিকরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সবচাইতে কষ্টদায়ক আচরণ কোনটি করেছিল, আমাকে বলুন। তখন তিনি ওকবা বিন আবু মু’আইত্বের অত্র ঘটনাটি বর্ণনা করেন’ (বুখারী হা/৩৮৫৬)।
রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের অত্র ঘটনায় তার প্রিয় আবুবকরের উপরোক্ত বক্তব্য অন্যূন দু’হাযার বছর পূর্বে মূসা (আঃ)-কে হত্যার পরিকল্পনাকারীদের সম্মুখে তাঁর জনৈক গোপন ভক্ত যে কথা বলেছিলেন, তার কুরআনী বর্ণনার সাথে শব্দে শব্দে মিলে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,
‘ফেরাঊন গোত্রের জনৈক মুমিন ব্যক্তি, যে তার ঈমান গোপন রাখত, লোকদের বলল, তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে, যিনি বলেন, আমার পালনকর্তা আল্লাহ এবং তিনি তোমাদের প্রতিপালকের নিকট থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদি সহ তোমাদের কাছে আগমন করেছেন?’ (গাফের/মুমিন ৪০/28) ।
আবুবকর (রাঃ)-এর উক্ত ঘটনা স্মরণ করে একদিন হযরত আলী (রাঃ) লোকদের বলেন, বল তো সবচেয়ে বড় বীর কে? তারা বলল, আপনি। তিনি বললেন, না। বরং আবুবকর। আমি দেখেছি কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কাপড় ধরে টানাটানি করছে ও গালি দিয়ে বলছে, তুমি আমাদেরকে বহু উপাস্য ছেড়ে এক উপাস্য গ্রহণ করতে বলে থাক’। সেই কঠিন সময়ে কেউ এগিয়ে যায়নি আবুবকর ছাড়া। তিনি একে ধরেন ওকে ঠেলেন, আর বলতে থাকেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক। তোমরা কি এমন একজন মানুষকে হত্যা করবে যিনি বলেন, আমার প্রতিপালক আল্লাহ? অতঃপর আলী (রাঃ) কাঁদতে থাকেন। অতঃপর বলেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি, তোমরা বল ফেরাউন কওমের ঈমান গোপনকারী মুমিন ব্যক্তি উত্তম না আবুবকর? লোকেরা চুপ থাকল। তখন তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! ঐ সময়ের ঘটনায় আবুবকর উত্তম। কেননা ফেরাঊন কওমের মুমিন ঈমান গোপন করেছিল। কিন্তু আবুবকর তার ঈমান প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছিলেন’
রাসূল (ছাঃ)-এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করা
(ক) উমাইয়া বিন খালাফের ভাই উবাই বিন খালাফ ছিল আরেক দুরাচার। সে যখন শুনতে পেল যে, তার সাথী ওরুবা বিন আবু মু’আইত্ব রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে বসে কিছু আল্লাহর বাণী শুনেছে, তখন ভীষণ ক্ষেপে গিয়ে ওক্কবাকে বাধ্য করল যাতে সে তৎক্ষণাৎ গিয়ে রাসূল (সাঃ) এর মুখে থুথু নিক্ষেপ করে আসে। ওক্কবা তাই-ই করল’। এ প্রসঙ্গে নাযিল হয়, যালেম সেদিন নিজের দু’হাত কামড়ে বলবে, হায়! যদি (দুনিয়াতে) রাসূলের পথ অবলম্বন করতাম’। ‘হায় দুর্ভোগ আমার! যদি আমি অমুককে বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’। ‘আমার কাছে উপদেশ (কুরআন) আসার পর সে আমাকে পথভ্রষ্ট করেছিল। বস্তুতঃ শয়তান মানুষের জন্য পথভ্রষ্টকারী’ (ফুরক্বান 25/27-29)
(খ) অনুরূপ এক ঘটনায় একদিন আবু লাহাবের পুত্র উতাইবা বিন আবু লাহাব এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, আমি সূরা নাজমের ১ ও ৮ আয়াত দু’টিকে অস্বীকার করি, বলেই সে হেঁচকা টানে রাসূল (সাঃ)-এর গায়ের জামা ছিঁড়ে ফেলল এবং তাঁর মুখে থুথু নিক্ষেপ করল। অথচ এই হতভাগা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা। যে তার পিতার কথা মত রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছুমকে তালাক দেয়। তার ভাই উৎবা একইভাবে রাসূল (সাঃ)-এর অপর কন্যা রুকাইয়াকে তালাক দেয়। পরে যার বিয়ে হযরত ওছমান (রাঃ)-এর সাথে হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে উম্মে কুলছূমের সাথে ওছমান (রাঃ)-এর বিবাহ হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন তাকে বদ দো’আ করে বললেন হে আল্লাহ! তুমি এর উপরে তোমার কোন একটি কুকুরকে বিজয়ী করে দাও’।
উক্ত ঘটনা সম্পর্কে কবি হাসসান বিন ছাবিত (রাঃ) কবিতা রচনা করেন। কিছুদিন পরে উতাইবা সিরিয়ায় ব্যবসায়িক সফরে গেলে সেখানে যারক্বা ) ( নামক স্থানে রাত্রি যাপন করে। এমন সময় হঠাৎ একটা বাঘকে সে তাদের চারপাশে ঘুরতে দেখে ভয়ে বলে উঠে, এ তাঁর এই “আল্লাহর কসম! এ আমাকে খেয়ে ফেলবে। এভাবেই তো মুহাম্মাদ আমার বিরুদ্ধে বদ দো’আ করেছিল। সে আমাকে হত্যাকারী। অথচ সে মক্কায় আর আমি শামে। অতঃপর বাঘ এসে সবার মধ্য থেকে তাকে ধরে নিয়ে ঘাড় মটকে হত্যা করল’।
মুখে পচা হাড়ের গুঁড়া ছুঁড়ে মারা
উবাই বিন খালাফ নিজে একবার পচা হাড্ডি চূর্ণ করে রাসূল (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে বলল, হে মুহাম্মাদ! তুমি কি ধারণা কর যে, একটা মানুষ মরে পচে-গলে যাওয়ার পর পুনরায় জীবিত হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন সে হাতে রাখা পচা হাড়ের গুঁড়া তাঁর মুখের উপরে ছুঁড়ে মারে’ (ইবনু হিশাম ১/৩৬১-৬২)। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘মানুষ আমাদের সম্পর্কে নানা উপমা দেয়। অথচ সে নিজের সৃষ্টির কথা ভুলে যায়। সে বলে, হাড়গুলিতে কে প্রাণ সঞ্চার করবে যখন ওটা পচে-গলে যাবে?’ ‘বলে দাও, ওগুলিকে জীবিত করবেন তিনি, যিনি প্রথমবার সেগুলিকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সকল বিষয়ে সুবিজ্ঞ’ (ইয়াসীন ৩৬/৭৮-৭৯)। এছাড়া এ প্রেক্ষিতে সূরা মারিয়াম ৬৬, ক্বাফ ৩ ও অন্যান্য আয়াত সমূহ নাযিল হয়। যদিও শানে নুযূল হিসাবে বর্ণিত ঘটনাসমূহের সনদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ‘মুরসাল’। তবে এটা নিশ্চিত যে, বিভিন্ন প্রশ্ন ও ঘটনার প্রেক্ষিতেই কুরআনের অধিকাংশ আয়াত নাযিল হয়েছে, যাতে রাসূল (সাঃ)-এর অন্তরে প্রশান্তি আসে। যেমন আল্লাহ বলেন, কাফেররা বলে যে, কেন কুরআন তাঁর প্রতি একসাথে নাযিল হল না? এমনিভাবেই আমরা এটি নাযিল করেছি এবং ক্রমে ক্রমে আবৃত্তি করেছি, যাতে আমরা তোমার অন্তরকে দৃঢ় করতে পারি’। ‘তারা তোমার নিকটে কোন সমস্যা উত্থাপন করলেই আমরা তার সঠিক জওয়াব ও সুন্দর ব্যাখ্যা দান করে থাকি’ (ফুরকান ২৫/৩২-৩৩)।
ছাহাবীগণের উপরে অত্যাচার
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর উপরে মানসিক ও দৈহিক অত্যাচারের কিছু ঘটনা আমরা ইতিপূর্বে জেনেছি। এক্ষণে আমরা তাঁর সাথীদের উপরে অত্যাচারের কিছু নমুনা পেশ করব।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, প্রথম সাতজন ব্যক্তি তাদের ইসলাম প্রকাশ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ), আবুবকর, আম্মার ও তার মা সুমাইয়া, ছোহায়েব, বেলাল ও মিক্বদাদ। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে আল্লাহ নিরাপত্তা দেন তাঁর চাচা আবু তালেবের মাধ্যমে, আবুবকরকে নিরাপত্তা দেন তার গোত্রের মাধ্যমে। আর বাকীদের মুশরিকরা পাকড়াও করে। তাদেরকে তারা লোহার পোষাক পরিয়ে প্রচন্ড দাবদাহের মধ্যে ফেলে রাখে। তারা যেভাবে খুশী নির্যাতন করে। কিন্তু বেলালের ব্যাপারটি ছিল ভিন্ন। সে নিজেকে আল্লাহর উপর সঁপে দিয়েছিল। লোকেরা তার পিছনে ছোকরাদের লেলিয়ে দেয়। তারা তাকে মক্কার অলি-গলিতে ঘুরায়। আর সে বলতে থাকে আহাদ, আহাদ’।  এখানে সাতজনের মধ্যে সুমাইয়ার স্বামী ইয়াসিরকে ধরা হয়নি। যদিও তিনিও ছিলেন একই সময়ের নির্যাতিত ছাহাবী’ (আল-ইছাবাহ, আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮)।
উল্লেখ্য যে, মুসলমানদের উপরে কাফিরদের এই অত্যাচারের কোন ধরাবাঁধা নিয়ম ছিল না কিংবা উঁচু-নীচু ভেদাভেদ ছিল না। তবে স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী সচ্ছল ও উঁচু স্তরের লোকদের চাইতে গরীব ও ক্রীতদাস শ্রেণীর মুসলমানদের উপরে অত্যাচার ও নির্যাতনের মাত্রা ছিল অনেক বেশী, যা অবর্ণনীয়। নিম্নে উদাহরণ স্বরূপ জাহেলী যুগে ছাহাবীগণের উপর নির্যাতনের কিছু নমুনা পেশ করা হ’ল।
হাবশায় ২য় হিজরত -সম্ভবতঃ যুলক্বা’দাহ ৫ম নববী বর্ষ)
হাবশার বাদশাহ কর্তৃক সদাচরণের খবর শুনে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের উপরে যুলুমের মাত্রা বাড়িয়ে দিল এবং কেউ যাতে আর হাবশায় যেতে না পারে, সেদিকে কড়া নযর রাখতে লাগল। কারণ এর ফলে তাদের দু’টি ক্ষতি ছিল। এক- বিদেশের মাটিতে কুরায়েশ নেতাদের যুলুমের খবর পৌঁছে গেলে তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। দুই- সেখানে গিয়ে মুসলমানেরা সংঘবদ্ধ হয়ে শক্তি সঞ্চয় করার সুযোগ পাবে। কিন্তু তাদের অত্যাচারের মাত্রা বৃদ্ধি এবং কড়া নযরদারী সত্ত্বেও জাফর বিন আবু ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৮২ বা ৮৩ জন পুরুষ এবং ১৮ বা ১৯জন মহিলা দ্বিতীয়বারের মত হাবশায় হিজরত করতে সমর্থ হন। এই দলে আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) ছিলেন কি-না সন্দেহ আছে’।
তাফসীরবিদগণের আলোচনায় আরেকটি বিষয় প্রতিভাত হয় যে, ৫ম নববী বর্ষে মুহাজিরগণের দ্বিতীয় যে দলটি হাবশায় হিজরত করেন, তাদের সাথে হযরত জাফর বিন আবু তালেব সম্ভবতঃ দু’বছর হাবশায় অবস্থান করেন। তিনি নাজাশী ও তাঁর সভাসদমন্ডলী এবং পোপ-পাদ্রী-বিশপসহ রাজ্যের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত পেশ করেন। এ সময় নাজাশীর দরবারে জাফরের দেওয়া ভাষণ নাজাশী ও তার সভাসদগণের অন্তর কেড়ে নেয়। ইসলামের সত্যতা ও শেষনবীর উপরে তাদের বিশ্বাস তখনই বদ্ধমূল হয়ে যায়। অতঃপর হাবশার মুহাজিরগণ যখন মদীনায় যাওয়ার সংকল্প করেন, তখন সম্রাট নাজাশী তাদের সাথে ৭০ জনের একটি ওলামা প্রতিনিধি দল মদীনায় প্রেরণ করেন। যাদের মধ্যে ৬২ জন ছিলেন আবিসিনীয় এবং ৮ জন ছিলেন সিরীয়। এরা ছিলেন খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সেরা ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব। সংসার বিরাগী দরবেশ সূলভ পোষাকে এই প্রতিনিধিদলটি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দরবারে পৌঁছলে তিনি তাদেরকে সূরা ইয়াসীন পাঠ করে শুনান। এ সময় তাদের দু’চোখ বেয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হ’তে থাকে। তারা বলে ওঠেন ইনজীলের বাণীর সাথে কুরআনের বাণীর কি অদ্ভূত মিল! অতঃপর তারা সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বায় আত করে ইসলাম কবুল করেন।
প্রতিনিধি দলটির প্রত্যাবর্তনের পর সম্রাট নাজাশী প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলের ঘোষণা দেন। যদিও প্রথম থেকেই তিনি শেষনবীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কিন্তু ধর্মনেতাদের ভয়ে প্রকাশ করেননি। অতঃপর তিনি একটি পত্র লিখে স্বীয় পুত্রের নেতৃত্বে আরেকটি প্রতিনিধি দল মদীনায় পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জাহাযটি পথিমধ্যে ডুবে গেলে আরোহী সকলের মর্মান্তিক সলিল সমাধি ঘটে।
উক্ত খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদলের মদীনায় গমন ও ইসলাম গ্রহণের প্রতি ইঙ্গিত করেই সূরা মায়েদাহ ৮২ হ’তে ৮৫ চারটি আয়াত নাযিল হয়।
আবু তালিবের নিকটে কুরায়েশ নেতাদের আগমন – প্রথমবার আগমন ৬ষ্ঠ নববী  বর্ষের মাঝামাঝি)
ইসলামের দাওয়াত বন্ধ করার জন্য নিবর্তনমূলক সবরকম চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় অবশেষে কুরায়েশদের ১০জন নেতা একত্রে আবু তালিবের কাছে এলেন। এই দলে ছিলেন ওত্ত্বা ও শায়বাহ বিন রাবী’আহ, আবু সুফিয়ান ছাখর ইবনু হারব, আবুল বাখতারী আছ বিন হিশাম, আসওয়াদ বিন মুত্ত্বালিব, আবু জাহল আমর ইবনু হেশাম (যিনি ‘আবুল হাকাম’ উপনামে পরিচিত ছিলেন), অলীদ বিন মুগীরাহ, নুবাইহ ও মুনাবিবহ বিন হাজ্জাজ ও ‘আছ বিন ওয়ায়েল এবং আরও কয়েকজন যারা তাদের সঙ্গে ছিলেন। তারা এসে বললেন, ‘হে আৰু তালেব! আপনার ভাতিজা আমাদের উপাস্যদের গালি দিয়েছে, আমাদের দ্বীনকে দোষারোপ করেছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা ঠাউরেছে এবং আমাদের বাপ-দাদাদের পথভ্রষ্ট মনে করেছে’। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন। নতুবা আমাদের ও তার মাঝ থেকে আপনি সরে দাঁড়ান। কেননা আপনিও আমাদের ন্যায় তার আদর্শের বিরোধী। সেকারণ আমরা আপনাকে তার ব্যাপারে যথেষ্ট মনে করি’। ধৈর্য্যের সঙ্গে তাদের কথা শুনে আবু তালেব তাদেরকে নম্র ভাষায় বুঝিয়ে বিদায় করলেন (ইবনু হিশাম ১/২৬৪-৬৫)।
দ্বিতীয়বার আগমন (প্রথমবারের কিছু পরে)
মুসলমানদের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং নির্যাতনের ভয়ে সকলে পার্শ্ববর্তী খ্রিষ্টান রাজ্য হাবশায় গিয়ে আশ্রয় নেওয়ায় নেতারা প্রমাদ গুণলেন। অতঃপর বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য এবং হিজরতকারীদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমর ইবনুল আছ ও আবু জাহলের বৈপিত্রেয় সহোদর ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী রাবী আহকে নাজাশীর দরবারে প্রেরণ করেন। কিন্তু তারা নিরাশ হয়ে ফিরে আসেন। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মুহাম্মাদের দাওয়াত একেবারেই বন্ধ করে দিতে হবে অথবা তাকে হত্যা করে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিতে হবে। কিন্তু মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে যেকোন কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পথে সবচাইতে বড় বাধা হ’লেন তার চাচা বর্ষীয়ান ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় গোত্রনেতা আৰু ত্বালিব। ফলে নেতারা পুনরায় আবু তালেবের কাছে এলেন এবং বললেন, আমাদের মধ্যে বয়সে, সম্মানে ও পদমর্যাদায় আপনি বিশেষ স্থানের অধিকারী। আমরা চেয়েছিলাম যে, আপনি আপনার ভাতিজাকে বিরত রাখবেন। কিন্তু আপনি তাকে বিরত রাখেননি। আল্লাহর কসম! আমরা আর এ ব্যক্তির ব্যাপারে ধৈর্য রাখতে পারছি না। কেননা এ ব্যক্তি আমাদের বাপ-দাদাদের গালি দিচ্ছে, আমাদের জ্ঞানীদের বোকা বলছে, আমাদের উপাস্যদের দোষারোপ করছে। এক্ষণে হয় আপনি তাকে বিরত রাখুন, নয়তো আমরা তাকে ও আপনাকে এ ব্যাপারে একই পর্যায়ে নামাবো। যতক্ষণ না আমাদের দু’পক্ষের একটি পক্ষ ধ্বংস হয়’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে আপনার ও আপনার বাপ-দাদাদের দ্বীনের বিরোধিতা করেছে, আপনার সম্প্রদায়ের ঐক্যকে বিভক্ত করেছে এবং তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছে। অতএব আমরা তাকে হত্যা করব’ (ইবনু হিশাম ১/২৬৭)।
গোত্রনেতাদের এই চূড়ান্ত হুমকি শুনে আবু তালেব দুশ্চিন্তায় পড়লেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-কে ডেকে এনে বললেন, আমার এর ‘হে ভাতিজা! তোমার বংশের নেতারা আমার কাছে এসেছিলেন এবং তারা এই এই কথা বলেছেন।… অতএব তুমি আমার উপরে এমন বোঝা চাপিয়ো না, যা বহন করার ক্ষমতা আমার নেই’। চাচার এই কথা শুনে তিনি তাকে ছেড়ে যাচ্ছেন ধারণা করে সাময়িকভাবে বিহবল নবী আল্লাহর উপরে গভীর আস্থা রেখে বলে উঠলেন, ‘হে চাচাজী! যদি তারা আমার ডান হাতে সূর্য এবং বাম হাতে চন্দ্র এনে দেয় তাওহীদের এই দাওয়াত বন্ধ করার বিনিময়ে, আমি তা কখনোই পরিত্যাগ করব না। যতক্ষণ না আল্লাহ এই দাওয়াতকে বিজয়ী করেন অথবা আমি তাতে ধ্বংস হয়ে যাই’ বলেই তিনি অশ্রুভরা নয়নে চলে যেতে উদ্যত হলেন। পরম স্নেহের ভাতিজার এই অসহায় দৃশ্য দেখে বয়োবৃদ্ধ চাচা তাকে পিছন থেকে ডাকলেন। তিনি তার দিকে মুখ তুলে তাকাতেই চাচা বলে উঠলেন, যাও ভাতিজা! তুমি যা খুশী প্রচার কর। আল্লাহর কসম! কোন কিছুর বিনিময়ে আমি তোমাকে ওদের হাতে তুলে দেব না’। এ সময় তিনি পাঁচ লাইন কবিতার মাধ্যমে স্বীয় দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। যেমন,
“আল্লাহর কসম! তারা কখনোই তাদের সম্মিলিত শক্তি নিয়েও তোমার কাছে পৌঁছতে পারবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি মাটিতে সমাহিত হবা। অতএব তুমি তোমার কাজ চালিয়ে যাও। তোমার উপরে কোন বাধা আসবে না। তুমি খুশী হও এবং এর ফলে তোমার থেকে চক্ষুসমূহ শীতল হৌক (আল-বিদায়াহ ৩/৪২)। এর দ্বারা বুঝা যায় যে, আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাঁর চাচার মাধ্যমে শত্রুদের হাত থেকে হেফাযত করেন। আল্লাহর এই বিধান সকল যুগের নিষ্ঠাবান মুমিনের জন্য সর্বদা কার্যকর।
রাসূল (ছাঃ)-কে দেওয়া আপোষ প্রস্তাবসমূহ (যিলহজ্জ ৬ষ্ঠ নববী বর্ষ)
কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের পূর্বে কুরায়েশ নেতারা রাসূল (সাঃ)-কে আপোষ প্রস্তাবের ফাঁদে আটকানোর চিন্তা করেন। সে মোতাবেক তারা মক্কার অন্যতম নেতা ওবা বিন রাবী আহকে সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে কয়েকটি প্রস্তাব দিয়ে পাঠান।
(১) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কাবা চত্বরে একাকী বসেছিলেন। তখন কুরায়েশ নেতাদের অনুমতি নিয়ে ওত্ত্বা তাঁর কাছে গিয়ে বসলেন এবং বললেন, হে ভাতিজা! তুমি আমাদের গোত্রের মধ্যে কেমন সম্মান ও উচ্চ মর্যাদায় আছ, তা তুমি ভালভাবেই জান। কিন্তু তুমি তোমার সম্প্রদায়ের নিকটে একটি ভয়ানক বিষয় নিয়ে এসেছ। তুমি তাদের জামা আতকে বিভক্ত করেছ। তাদের জ্ঞানীদের বোকা বলেছ। তাদের উপাস্যদের ও তাদের দ্বীনকে তুমি মন্দ বলেছ। এই দ্বীনের উপর মৃত্যুবরণকারী তাদের বাপ-দাদাদের তুমি কাফের বলেছ’। অতএব আমি তোমার নিকটে কয়েকটি বিষয় পেশ করছি। এগুলি তুমি ভেবে দেখ, আশা করি তুমি সেগুলির কিছু হ’লেও মেনে নিবে। জওয়াবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, বলুন! হে আৰু অলীদ, আমি শুনব। তখন তিনি বললেন, হে ভাতিজা! তোমার এই নতুন দ্বীন প্রচারের উদ্দেশ্য যদি সম্পদ উপার্জন হয়, তাহ’লে তুমি বললে আমরা তোমাকে সেরা ধনী বানিয়ে দেব। আর যদি তোমার উদ্দেশ্য নেতৃত্ব লাভ হয়, তাহ’লে আমরা তোমাকে আমাদের নেতা বানিয়ে দেব। আর যদি আরবের বাদশাহ হ’তে চাও, তাহ’লে আমরা তোমাকে বাদশাহ বানিয়ে দেব। আর যদি মনে কর, তোমার মাথার জন্য জিনের চিকিৎসা প্রয়োজন, তাহ’লে আমরাই তা আরোগ্যের জন্য সেরা চিকিৎসককে এনে তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করব এবং সব খরচ আমরাই বহন করব’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, এমনকি নেতারা এ প্রস্তাবও দিয়েছিল যে, তুমি নারীদের মধ্যে যাকে চাও, তার সাথে তোমাকে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিব। আমাদের একটাই মাত্র দাবী, তুমি তোমার ঐ নতুন দ্বীনের দাওয়াত পরিত্যাগ কর’।
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ৫৪ আয়াত বিশিষ্ট সূরা হা-মীম সাজদাহ পাঠ করে শুনাতে লাগলেন। শুনতে শুনতে ওত্ত্বা মন্ত্রমুগ্ধের মত হয়ে গেলেন। এক বর্ণনায় এসেছে, যখন রাসূল (সাঃ) ১৩তম আয়াত পাঠ করলেন, তখন ওৎবা রাসূল (সাঃ)-এর মুখের উপরে হাত চেপে গযব নাযিলের ভয়ে বলে উঠলেন, আল্লাহর দোহাই! তুমি তোমার বংশধরগণের উপরে দয়া করা। অতঃপর ৩৮তম আয়াতের পর রাসূল (সাঃ) সিজদা করলেন এবং উঠে বললেন, “আবুল অলীদ আপনি তো সবকিছু শুনলেন। এখন আপনার যা বিবেচনা হয় করুন’। এরপর ওৎবা উঠে গেলেন।
কুরায়েশ নেতারা সাগ্রহে ওবার কাছে জমা হ’লে তিনি বললেন, নেতারা শুনুন! আমি মুহাম্মাদের মুখ থেকে এমন বাণী শুনে এসেছি, যেরূপ বাণী আমি কখনো শুনিনি। যা কোন কবিতা নয় বা জাদুমন্ত্র নয়। সে এক অলৌকিক বাণী। আপনারা আমার কথা শুনুন! মুহাম্মাদকে বাধা দিবেন না। তাকে তার পথে ছেড়ে দিন’। লোকেরা হতবাক হয়ে বলে উঠলো আল্লাহর কসম হে আবুল অলীদ! মুহাম্মাদ তার কথা দিয়ে আপনাকে জাদু করে ফেলেছে’।
(২) একদিন যখন রাসূল (সাঃ) কা’বাগৃহ তাওয়াফ করছিলেন, তখন আসওয়াদ বিন আব্দুল মুতালিব, অলীদ বিন মুগীরাহ, উমাইয়া বিন খালাফ, ‘আছ বিন ওয়ায়েল প্রমুখ। মক্কার বিশিষ্ট নেতৃবর্গ এসে সরাসরি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে প্রস্তাব দেন, হে মুহাম্মাদ! এসো আমরা ইবাদত করি, যার তুমি ইবাদত কর এবং তুমি ইবাদত কর, যার আমরা ইবাদত করি। তাতে আমরা ও তুমি আমাদের উপাসনার কাজে পরস্পরে অংশীদার হব’। তখন আল্লাহ সূরা কাফেরূন নাযিল করেন।যাতে কাফেরদের সঙ্গে পুরাপুরি বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করা হয়।
তৃতীয়বার আবু তালিবের নিকট আগমন (১০ম নববী বর্ষ)
হুমকি, লোভনীয় প্রস্তাব ও বয়কট কোনটাতে কাজ না হওয়ায় এবং ইতিমধ্যে আবু তালিবের স্বাস্থ্যহানির খবর শুনে মক্কার নেতারা তৃতীয়বার তাঁর সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নেন। সেমতে আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, উমাইয়া বিন খালাফ, ওরা ও শায়বা বিন রাবী’আহ সহ প্রায় ২৫ জন নেতা আবু তালেবের কাছে আসেন এবং বলেন, হে আবু তালেব! আপনি যে মর্যাদার আসনে আছেন, তা আপনি জানেন। আপনার বর্তমান অবস্থাও আপনি বুঝতে পারছেন। আমরা আপনার জীবনাশংকা করছি। এমতাবস্থায় আপনি ভালভাবে জানেন যা আমাদের ও আপনার ভাতিজার মধ্যে বিদ্যমান রয়েছে। এক্ষণে আপনি তাকে ডাকুন এবং উভয় পক্ষে অঙ্গীকার নিন যে, সে আমাদের ও আমাদের দ্বীন থেকে বিরত থাকবে এবং আমরাও তার থেকে বিরত থাকব। তখন আবু তালেব রাসূল (সাঃ)-কে ডাকালেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)  তাদের সম্মুখে এসে বললেন, হ্যাঁ, একটি কালেমার ওয়াদা আপনারা আমাকে দিন। তাতে আপনারা আরবের বাদশাহী পাবেন এবং অনারবরা আপনাদের অনুগত হবে’। আবু জাহ্নু খুশী হয়ে বলে উঠল, তোমার পিতার কসম, এমন হলে একটা কেন দশটা কালেমা পাঠ করতে রাযী আছি। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আপনারা বলুন, ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই’। আর তাঁকে ছাড়া অন্য যাদের পূজা করেন, সব পরিত্যাগ করুন’।
তখন তারা দু’হাতে তালি বাজিয়ে বলে উঠলো ‘হে মুহাম্মাদ! সব উপাস্য বাদ দিয়ে তুমি একজন উপাস্য চাও? নিশ্চয়ই তোমার এ বিষয়টি বড়ই বিস্ময়কর!’ এরপর তারা পরস্পরে বলল, আল্লাহর কসম! এই ব্যক্তি তোমাদের কিছুই দিবে না, যা তোমরা চাচ্ছ। অতএব  চলো! তোমরা তোমাদের বাপ-দাদার ধর্মের উপরে চলতে থাক, যতক্ষণ না আল্লাহ তোমাদের ও তার মধ্যে একটা ফায়ছালা করে দেন’। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ সূরা ছোয়াদের ১ হতে ৭ আয়াতগুলি নাযিল করেন।
(১) ছোয়াদ- শপথ উপদেশপূর্ণ কুরআনের (২) বরং কাফেররা অহমিকা ও হঠকারিতায় লিপ্ত (৩) তাদের পূর্বেকার কত জনগোষ্ঠীকে আমরা ধ্বংস করেছি। তারা আর্তনাদ করেছে। কিন্তু বাঁচার কোন উপায় তাদের ছিল না (৪) তারা বিস্ময়বোধ করে যে, তাদের কাছে তাদেরই মধ্য থেকে একজন সতর্ককারী আগমন করেছেন। আর কাফেররা বলে এতো একজন জাদুকর ও মহা মিথ্যাবাদী (৫) সে কি বহু উপাস্যের বদলে একজন উপাস্যকে সাব্যস্ত করে? নিশ্চয়ই এটা এক বিস্ময়কর ব্যাপার (৬) তাদের নেতারা একথা বলে চলে যায় যে, তোমরা তোমাদের উপাস্যদের পূজায় অবিচল থাকো। নিশ্চয়ই (মুহাম্মাদের) এ বক্তব্য কোন বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণোদিত (৭) আমরা তো পূর্বেকার ধর্মে এরূপ কোন কথা শুনিনি। এটা মনগড়া উক্তি বৈ কিছু নয়’ (ছোয়াদ ৩৮/১-৭)।
সর্বশেষ মৃত্যুকালে আগমন (রজব ১০ম নববী বর্ষ)
চতুর্থ ও শেষবার নেতারা এসেছিলেন আবু তালিবের মৃত্যুকালে, যেন তিনি তাওহীদের কালেমা পাঠ না করেন ও বাপ-দাদার ধর্মে তথা শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন, সেটা নিশ্চিত করার জন্য। বস্তুতঃ একাজে তারা সফল হয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর শত আকুতি উপেক্ষা করে সেদিন আবু তালেব আবু জাহ্ণের কথায় সায় দিয়ে শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেন। যথাস্থানে তার আলোচনা আসবে ইনশাআল্লাহ (দ্রঃ ১৮০ পৃঃ)।
ওমরের ইসলাম গ্রহণ
(৬ষ্ঠ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাস)
হামযার ইসলাম গ্রহণের মাত্র তিন দিন পরেই আল্লাহর অপার অনুগ্রহে আরেকজন কুরায়েশ বীর ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব আকস্মিকভাবে মুসলমান হয়ে যান। ওয়াকেদীর হিসাব মতে, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর এবং তখন মুসলমানের সংখ্যা ছিল ৪০ থেকে ৫৬ জন। যাদের মধ্যে ১০ বা ১১ জন ছিলেন নারী। এটি ছিল হাবশায় প্রথম হিজরতের পরের ঘটনা। ইবনু কাছীর বলেন, ওমরকে দিয়ে মুসলমানের সংখ্যা ৪০ পূর্ণ হয়, কথাটি সঠিক নয়। কেননা তার পূর্বে ৮০ জনের উপরে মুসলমান হারশায় হিজরত করেছিল। তবে এটি হাতে পারে যে, দারুল আরক্বামে গিয়ে ইসলাম কবুল করার সময়ে সেখানে মুসলিম নারী-পুরুষের সংখ্যা ছিল ৪০-এর কাছাকাছি (আল-বিদায়াহ ৩/৭৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে ৩১ জন (ঐ, ৩০ পৃঃ)। ফলে সেদিন ওমরকে দিয়ে ৪০ পূর্ণ হয়।
তিনি যে আগে থেকেই ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন তার প্রমাণ হিসাবে বলা যায় যে, হাবশা যাত্রী মহিলা মুহাজির উম্মে আব্দুল্লাহ বিনতে আবু হাছমাহ (সা) বলেন, আমরা হাবশা যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আমার স্বামী আমের তখন প্রয়োজনীয় কাজে বাইরে ছিলেন। এমন সময় ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এলেন। তখন তিনি মুশরিক ছিলেন। বললেন, এগুলি মনে হয় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি? বললাম, হ্যাঁ। আমরা অবশ্যই আল্লাহর যমীনে বেরিয়ে যাব। তোমরা আমাদের কষ্ট দিচ্ছ ও নির্যাতন করছ। নিশ্চয়ই আল্লাহ একটা পথ বের করে দিবেন’। তখন ওমর বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সাথী হৌন’! এদিন আমি তাকে অত্যন্ত দুঃখিত ও সংবেদনশীল দেখতে পাই’  রাবী আব্দুল্লাহ বিন আমের জ্যেষ্ঠ তাবেঈ ছিলেন। যিনি প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে তার মায়ের সূত্রে ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বুখারী তার সমালোচনা করেননি। ইবনু হিববান তার। বিশুদ্ধতার সাক্ষ্য দিয়েছেন’। তবে হাফেয ইবনু হাজার বলেন, বোন ফাতেমার গৃহে প্রবেশ ও তার নিকট থেকে কুরআন শ্রবণ তাঁর ইসলাম গ্রহণের প্রত্যক্ষ কারণ হাতে পারে। কিন্তু উক্ত বিষয়ে বর্ণিত প্রসিদ্ধ ঘটনাটির সনদ ‘যঈফ’
এছাড়াও মতনে বৈপরিত্য আছে। যেমন কোন বর্ণনায় এসেছে যে, কুরায়েশ নেতারা তাকে পাঠিয়েছিলেন। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি নিজ থেকে গিয়েছিলেন’ (ইবনু সা’দ, দারাকুত্নী)। কোন বর্ণনায় এসেছে, তিনি বোনের ঘরে সূরা ত্বোয়াহা ও সূরা তাকভীর ১৪ আয়াত পর্যন্ত পড়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৫)। কোন বর্ণনায় এসেছে সূরা হাদীদ’ পড়েছিলেন (বায়হাক্বী, দালায়েল হা/৫১৮)। অথচ সূরা হাদীদ মদীনায় অবতীর্ণ হয়েছে। অন্য বর্ণনায় এসেছে বায়তুল্লাহতে রাসূল (সাঃ)-এর ছালাত অবস্থায় সূরা হা ক্বাহ শুনে তার অন্তরে ইসলাম দৃঢ় হয়’ (আহমাদ হা/১০৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি রাতের বেলা কাবার গেলাফের মধ্যে লুকিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর ছালাতের ক্বিরাআত শুনছিলেন। তিনি বলেন, এমন কথা আমি কখনো শুনিনি। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) বেরিয়ে গেলে আমি তাঁর পিছু নেই। তখন তিনি বললেন, কে? আমি বললাম, ওমর। তিনি বললেন, হে ওমর! দিনে-রাতে কখনোই তুমি আমার পিছু নিতে ছাড়ো না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম যে, উনি আমাকে বদ দো’আ করতে পারেন। তখন আমি কালেমা। শাহাদাত পাঠ করলাম। রাসূল (সাঃ) বললেন, হে ওমর! এটি গোপন রাখা। আমি বললাম, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, আমি অবশ্যই প্রকাশ করব, যেভাবে শিরক প্রকাশ করতাম’ (মুছান্নাফ ইবনু আবী শায়বাহ হা/৩৭৭৫৪)। বর্ণনাগুলি সবই যঈফ’ (মা শা-আ ৫৭ পৃঃ)। উল্লেখ্য যে, দুর্বল সূত্র সমূহের আধিক্য সবসময় কোন বর্ণনার শক্তি বৃদ্ধি করেনা। বরং অনেক সময় তার দুর্বলতাই বৃদ্ধি করে। মুহাদ্দিছ বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে সতর্ক করেছেন’ (মা শা-আ ৫৯ পৃঃ)।
আমরা মনে করি ওমরের ইসলাম গ্রহণ ছিল রাসুল (সাঃ)-এর বিশেষ দোআর ফল। কেননা তিনি তাঁর জন্য খাছভাবে দোআ করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব-এর মাধ্যমে ইসলামকে শক্তিশালী কর’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘হে আল্লাহ! আৰু জাহল অথবা ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব এই দুই ব্যক্তির মধ্যে যিনি তোমার নিকট অধিক প্রিয়, তার মাধ্যমে তুমি ইসলামকে শক্তিশালী করা  পরের দিন সকালে ওমর দারুল আরকামে এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে ইসলাম কবুল করেন এবং কা’বাগৃহে গিয়ে প্রকাশ্যে ছালাত আদায় করেন। এতে প্রমাণিত হয় যে, ওমরই ছিলেন আল্লাহর নিকটে অধিকতর প্রিয় ব্যক্তি।
তবে এটা নিশ্চিত যে, ওমর ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী এবং আরবী ভাষালংকারে অভিজ্ঞ ব্যক্তি। ফলে কুরআনের সারগর্ভ ও আকর্ষণীয় বাকভঙ্গি এবং ক্বিয়ামত ও জান্নাত জাহান্নামের বর্ণনাসমূহ তাঁর হৃদয়ে গভীরভাবে রেখাপাত করে। যা তাকে ইসলামের দিকে চুম্বকের মত টেনে আনে। সর্বোপরি রাসূল (সাঃ)-এর দো’আ তাঁর শানে কবুল হওয়ায় তিনি দ্রুত এসে ইসলাম কবুল করেন।
ওমরের ইসলাম পরবর্তী ঘটনা
ইসলাম কবুলের পরপরই তিনি ইসলামের সবচেয়ে বড় দুশমন আবু জাহলের গৃহে গমন করেন এবং তার মুখের উপরে বলে দেন, ‘আমি তোমার কাছে এসেছি এ খবর দেওয়ার জন্য যে, আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মুহাম্মাদের উপরে ঈমান এনেছি এবং তিনি যে শরী’আত এনেছেন, আমি তা সত্য বলে জেনেছি’। একথা শুনেই আবু জাহল সরোষে তাকে গালি দিয়ে বলে ওঠেন, আল্লাহ তোমার মন্দ করুন এবং তুমি যে খবর নিয়ে এসেছ, তার মন্দ করুন’। অতঃপর তার মুখের উপরে দরজা বন্ধ করে ভিতরে চলে যান।
পুত্র আব্দুল্লাহ বিন ওমর বালক অবস্থায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে বলেন, এরপর ওমর গেলেন সে সময়ের সেরা মাউথ মিডিয়া জামীল বিন মামার আল-জুমাহীর  কাছে এবং তাকে বললেন যে, আমি মুসলমান হয়ে গেছি’। সে ছিল কুরায়েশ বংশের সেরা ঘোষক এবং অত্যন্ত উচ্চ কণ্ঠের অধিকারী। গুরুত্বপূর্ণ কোন সংবাদ তার মাধ্যমেই সর্বত্র প্রচার করা হ’ত। ওমর (রাঃ)-এর মুখ থেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের খবর শোনামাত্র সে বেরিয়ে পড়ল। আর চিৎকার দিয়ে সবাইকে শুনাতে থাকল, শুনে রাখো, খাত্ত্বাবের পুত্র ওমর ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে’। ওমর (রাঃ) তার পিছনেই ছিলেন। তিনি বললেন, ‘সে মিথ্যা বলেছে। বরং আমি মুসলমান হয়েছি’। একথা শোনা মাত্র চারিদিক থেকে লোক জমা হয়ে গেল এবং সকলে ওমরের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গণপিটুনী শুরু করল। এই মারপিট দুপুর পর্যন্ত চলল। এ সময় কাফিরদের উদ্দেশ্যে ওমর (রাঃ) আল্লাহর কসম দিয়ে বলেন, যদি আমরা আজ সংখ্যায় তিনশা পুরুষ হ’তাম, তবে দেখতাম মক্কায় তোমরা থাকতে, না আমরা থাকতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪৯)।
এই ঘটনার পর নেতারা ওমরকে হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাড়ী আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল। ওমর (রাঃ) ঘরের মধ্যেই ছিলেন। এমন সময় তাদের গোত্রের সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ বনু সাহম গোত্রের জনৈক নেতা আছ বিন ওয়ায়েল সাক্ষী সেখানে এসে উপস্থিত হ’লেন। ওমর (রাঃ) তাকে বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি বিধায় আপনার সম্প্রদায় আমাকে হত্যা করতে চায়’। তিনি বলে উঠলেন, কখনোই তা হবার নয়’। বলেই তিনি সোজা চলে গেলেন জনতার সামনে। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এখানে জটলা করছ কেন? তারা বলল, ইবনুল খাত্ত্বাব ধর্মত্যাগী হয়ে গেছে। তিনি বললেন, যাও! সেখানে যাবার কোন প্রয়োজন নেই’। তার কাছে একথা শুনে লোকেরা ফিরে গেল।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন,. “ওমর ইসলাম গ্রহণের আগ পর্যন্ত আমরা কা’বাগৃহে ছালাত আদায়ে সক্ষম হইনি। তিনি ইসলাম গ্রহণের পর কুরায়েশদের সাথে লড়াই করেন ও কা’বাগৃহে ছালাত আদায় করেন এবং আমরা তাঁর সাথে ছালাত আদায় করি’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২)। তিনি আরও বলেন, ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে আমরা সর্বদা শক্তিশালী ছিলাম’ (বুখারী হা/৩৬৮৪)। ওমর (রাঃ) যখন আততায়ীর দ্বারা আহত হন, তখন ইবনু আববাস (রাঃ) তাঁর উদ্দেশ্যে বলেন, যখন আপনি ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন তখন আপনার ইসলাম ছিল শক্তিশালী। আল্লাহ আপনার মাধ্যমে ইসলামকে, আল্লাহর রাসূলকে ও তাঁর সাধীদেরকে বিজয়ী করেনা
আবু ত্বালিব ও খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু , আবু ত্বালিবের মৃত্যু -রজব ১০ম নববী বর্ষ)
১০ম নববী বর্ষের মুহাররম মাসে ঠিক তিন বছরের মাথায় বয়কট শেষ হওয়ার ৬ মাস পরে রজব মাসে আবু ত্বালিবের মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে আবু জাহল, আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া প্রমুখ মুশরিক নেতৃবৃন্দ তাঁর শিয়রে বসে ছিলেন। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মৃত্যুপথযাত্রী পরম শ্রদ্ধেয় চাচাকে বললেন, ‘হে চাচাজী! আপনি ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কালেমাটি পাঠ করুন, যাতে আমি তার কারণে আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে সাক্ষ্য দান করতে পারি’। জবাবে আৰু ত্বালিব বলেন, “হে ভাতিজা! যদি আমার পরে তোমার বংশের উপর গালির ভয় না থাকত এবং কুরায়েশরা যদি এটা না ভারত যে, আমি মৃত্যুর ভয়ে এটা বলেছি ও তোমাকে খুশী করার জন্য বলেছি, তাহালে আমি অবশ্যই ওটা বলতাম’ (ইবনু হিশাম ১/৪১৮)। অতঃপর যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন আৰু জাহল ও তার সহোদর বৈপিত্রেয় ভাই আব্দুল্লাহ ইবনু আবী উমাইয়া বারবার তাঁকে উত্তেজিত করতে থাকেন এবং বলেন, আপনি কি আব্দুল মুত্তালিবের ধর্ম ত্যাগ করবেন’? জবাবে আৰু ত্বালিবের মুখ দিয়ে শেষ বাক্য বেরিয়ে যায়, আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের দ্বীনের উপরো (আর-রাউফুল উনুফ ২/২২৩)। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলে উঠলেন, আমি আপনার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করে যাব। যতক্ষণ না আমাকে নিষেধ করা হয়। ফলে আয়াত নাযিল হয় ‘নবী ও ঈমানদারগণের জন্য সিদ্ধ নয় যে, তারা ক্ষমা প্রার্থনা করুক মুশরিকদের জন্য। যদিও তারা নিকটাত্মীয় হয়, একথা স্পষ্ট হয়ে যাওয়ার পর যে তারা জাহান্নামের অধিবাসী’ (তওবা ৯/১১৩)।
এরপর রাসূল (সাঃ)-কে সান্ত্বনা দিয়ে আয়াত নাযিল হয়, নিশ্চয়ই তুমি হেদায়াত করতে পার না যাকে তুমি ভালবাসো। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হেদায়াত করে থাকেন। আর তিনি হেদায়াতপ্রাপ্তদের সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত’ (কাছাছ ২৮/৫৬)।  উল্লেখ্য যে, সূরা তওবাহ মাদানী সূরা হালেও তার মধ্যে ১১১-১১৩ আয়াত তিনটি বায়আতে কুবরা ও আবু তালিবের মৃত্যু প্রসঙ্গে মক্কায় নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী, ইবনু কাছীর)।
এভাবে হেদায়াতের আলোকবর্তিকা স্বীয় ভাতিজাকে সবকিছুর বিনিময়ে আমৃত্যু আগলে রেখেও শেষ মুহূর্তে এসে পরকালীন সৌভাগ্যের পরশমণি হাতছাড়া হয়ে গেল। স্নেহসিক্ত ভাতিজার প্রাণভরা আকুতি ব্যর্থ হ’ল এবং শয়তানের প্রতিমূর্তি গোত্রনেতাদের প্ররোচনা জয়লাভ করল। পিতৃধর্মের বহুত্ববাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেই তিনি দুনিয়া থেকে বিদায় হ’লেন। এ দৃশ্য যে রাসূল (ছাঃ)-এর জন্য কত বেদনাদায়ক ছিল, তা আখেরাতে বিশ্বাসী প্রকৃত মুমিনগণ উপলব্ধি করতে পারেন। কেননা যে চাচা দুনিয়াবী কারাগারের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশা থেকে সর্বদা ঢালের মত তাঁকে রক্ষা করেছেন এবং নিজে অমানুষিক কষ্ট ও দুঃখ সহ্য করেছেন, সেই চাচা দুনিয়া থেকে বিদায় গ্রহণের পরে পুনরায় জাহান্নামের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হবেন, এটা তিনি কিভাবে ভাবতে পারেন? বলা বাহুল্য এভাবেই সর্বদা তাক্বদীর বিজয়ী হয়ে থাকে।
একদিন চাচাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আখেরাতে আবু তালিবের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জাহান্নামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে হালকা আযাবপ্রাপ্ত হবেন আৰু ত্বালিব। তিনি আগুনের দু’টি জুতা পরিহিত হবেন, যাতে তাঁর মাথার মগয় গলে টগবগ করে ফুটবো । প্রিয় চাচা আবাস (রাঃ) একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আবু তালেব আপনাকে যেভাবে হেফাযত ও সহযোগিতা করেছেন, তার বিনিময়ে আপনি কি তাঁকে কোন উপকার করতে পারবেন? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। আমি তাকে জাহান্নামের গভীরে দেখতে পেলাম। অতঃপর তাকে (আল্লাহর হুকুমে) সেখান থেকে বের করে টাখনু পর্যন্ত উঠিয়ে আনলাম। যদি আমি না হাতাম, তাহ’লে তিনি জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্তরে থাকতেন’ (মুসলিম হা/২০৯)। আবু সাঈদ খুদরীর বর্ণনায় এসেছে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, সম্ভবতঃ ক্বিয়ামতের দিন আমার সুফারিশ তার উপকারে আসবে। অতঃপর তাকে জাহান্নামের অগভীর স্থানে নেওয়া হবে, যা তার টাখনু পর্যন্ত পৌঁছবে এবং তাতেই তার মস্তিষ্ক আগুনে টগবগ করে ফুটবে, যেমন উত্তপ্ত কড়াইয়ে পানি ফুটে থাকে’।
অতএব আবু তালিবের এই হালকা আযাব তার আমলের কারণে নয়, বরং তা হবে রাসূল (সাঃ)-এর বিশেষ সুফারিশের কারণে। আর সেটা হবে রাসূল (সাঃ) -এর বিশেষত্বের অন্তর্ভুক্ত ও তার উচ্চ মর্যাদার কারণে, যা আল্লাহ তাঁকে দান করেছেন। কেননা আবু ত্বালিব শিরকের উপর মৃত্যুবরণ করেছিলেন। আর আল্লাহ বলেন, আল্লাহ শিরকের পাপ ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত তিনি যাকে চান, তার সব পাপ ক্ষমা করতে পারেন’ (নিসা ৪/৪৮, ১১৬)। তিনি বলেন, কিয়ামতের দিন মুশরিকদের জন্য সুফারিশকারীদের কোন সুফারিশ কাজে আসবে না (মুদ্দাছছির ৭৪/৪৮)।
খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যু (রামাযান ১০ম নববী বর্ষ)
স্নেহশীল চাচা আবু ত্বালিবের মৃত্যুর অনধিক তিন মাস পরে দশম নববী বর্ষের রামাযান মাসে প্রাণাধিক প্রিয়া স্ত্রী খাদীজাতুল কুবরা ‘তাহেরা’-র মৃত্যু হয় (আর-রাহীক্ব ১১৬ পৃঃ)। তবে ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আবু ত্বালিবের মৃত্যুর তিন দিন পরে খাদীজার মৃত্যু হয় (যাদুল মাআদ ৩/২৮)। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর এবং রাসূল (সাঃ)-এর বয়স ছিল ৫০ বছর।
দীর্ঘ তিন বছর যাবৎ বয়কটকালীন নিদারুণ কষ্ট অবসানের মাত্র ৬ মাসের মাথায় চাচা, অতঃপর স্ত্রীকে হারিয়ে শত্রু পরিবেষ্টিত ও আশ্রয়হারা নবীর অবস্থা কেমন হয়েছিল, তা চিন্তাশীল মাত্রই বুঝতে পারেন। চাচা আবু তালেব ছিলেন সামাজিক জীবনে রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ঢাল স্বরূপ। অন্যদিকে পারিবারিক ও অর্থনৈতিক জীবনে খাদীজা ছিলেন তাঁর বিশ্বস্ততম নির্ভরকেন্দ্র। দাম্পত্য জীবনের পঁচিশ বছর সেবা ও সাহচর্য দিয়ে, বিপদে শক্তি ও সাহস যুগিয়ে, অভাব-অনটনে আর্থিক সহযোগিতা দিয়ে, হেরা গুহায় নিঃসঙ্গ ধ্যান ও সাধনাকালে অকুণ্ঠ সহমর্মিতা দিয়ে, নতুনের শিহরণে ভীত-চকিত রাসূলকে অনন্য সাধারণ প্রেরণা, উৎসাহ ও পরামর্শ দিয়ে, অতুলনীয় প্রেম, ভালবাসা ও সহানুভূতি দিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে তিনি ছিলেন আল্লাহর পক্ষ থেকে এক জীবন্ত নে’মত স্বরূপ। তিনি ছিলেন শেষ সন্তান ইবরাহীম ব্যতীত রাসূল (সাঃ)-এর সকল সন্তানের মা। তিনি ছিলেন বিশ্বসেরা চারজন সম্মানিতা মহিলার অন্যতম। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বলেন, ‘জান্নাতী মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হ’লেন খাদীজা বিনতে খুওয়াইলিদ, ফাতেমা বিনতে মুহাম্মাদ, মারিয়াম বিনতে ইমরান ও ফেরাউনের স্ত্রী আসিয়া বিনতে মুযাহিম’।
খাদীজা (রাঃ) ছিলেন সেই মহীয়সী মহিলা যাকে জিব্রীল নিজের পক্ষ হ’তে ও আল্লাহর পক্ষ হ’তে রাসূল (সাঃ)-এর মাধ্যমে তাঁকে সালাম দেন এবং জান্নাতে তাঁর জন্য বিশেষভাবে নির্মিত মুক্তাখচিত প্রাসাদের সুসংবাদ দেন।
তিনিই একমাত্র স্ত্রী যার জীবদ্দশায় রাসূল (সাঃ) অন্য কোন স্ত্রী গ্রহণ করেননি এবং তার মৃত্যুর পরেও আজীবন রাসূল (ছাঃ) তাকে বারবার স্মরণ করেছেন। অন্য স্ত্রীদের সামনে অকুণ্ঠচিত্তে তার প্রশংসা করেছেন। এমনকি তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে খাদীজার বান্ধবীদের কাছে উপঢৌকন পাঠাতেন।
সওদার সাথে বিবাহ (শাওয়াল ১০ম নববী বর্ষ)
খাদীজা (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর বিপর্যস্ত সংসারের হাল ধরার জন্য এবং মাতৃহারা কন্যাদের দেখাশুনার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাওদাহ বিনতে যাম আহ নাম্নী জনৈকা বিধবা মহিলাকে বিবাহ করেন ১০ম নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে। উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর ৪ কন্যার মধ্যে ৩য় ও ৪র্থ উম্মে কুলছুম ও ফাতেমা তখন অবিবাহিতা ছিলেন। সাওদা ও তার পূর্ব স্বামী সাকরান বিন আমর  উভয়ে ইসলাম কবুল করার পর হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর সেখানেই অথবা সেখান থেকে মক্কায় ফিরে এসে তার স্বামী ইনতেকাল করেন। এ সময় মৃত স্বামীর পাঁচটি বা ছয়টি সন্তানের গুরুভার এসে পড়েছিল সওদার উপরে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার দুঃখ-দুর্দশা লাঘবের জন্য তার সন্তানদের লালন-পালনের দায়িত্বসহ সওদাকে বিয়ে করেন। সওদা অত্যন্ত দৃঢ় ঈমানের ও বলিষ্ঠ চরিত্রের মহিলা ছিলেন। তিনিই প্রথমে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর তার প্রভাবে তার স্বামী সাকরান ইসলাম কবুল করেন। তাঁরা ১ম হাবশায় হিজরতকারী ৮৩ জনের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। ইসলামের জন্য তাদেরকে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করতে হয় (ইবনু হিশাম ১/৩২১-৩২)।
জিনদের ইসলাম গ্রহণ
তায়েফ থেকে ফেরার পথে জিনেরা কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করে। জিনেরা দু’বার রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আসে। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ১০ম নববী বর্ষে তায়েফ সফর থেকে ফেরার পথে তিনি ওকাষ বাজারের দিকে যাত্রাকালে নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে কুরআন পাঠ করছিলেন। তখন জিনেরা সেই কুরআন শুনে ইসলাম কবুল করল এবং তাদের জাতির কাছে ফিরে এসে বলল, হে আমাদের জাতি! আমরা এক বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আমরা কখনো আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)।
দ্বিতীয় বারের বিষয়ে ইবনু মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমরা সবাই মক্কার বাইরে রাত্রিকালে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। কিন্তু এক সময় তিনি হারিয়ে গেলেন। আমরা ভয় পেলাম তাঁকে জিনে উড়িয়ে নিয়ে গেল, নাকি কেউ অপহরণ করল। আমরা চারদিকে খুঁজতে থাকলাম। কিন্তু না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তায় রাত কাটালাম। রাতটি ছিল আমাদের জন্য খুবই ‘মন্দ রাত্রি’ । সকালে তাঁকে আমরা হেরা পাহাড়ের দিক থেকে আসতে দেখলাম। অতঃপর তিনি আমাদের বললেন, জিনদের একজন প্রতিনিধি আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি গিয়ে তাদেরকে কুরআন শুনালাম। অতঃপর তিনি আমাদেরকে সাথে করে নিয়ে গেলেন এবং জিনদের নমুনা ও তাদের আগুনের চিহ্নসমূহ দেখালেন। অতঃপর বললেন, তোমরা শুকনা হাড্ডি ও গোবর ইস্তিঞ্জাকালে ব্যবহার করো না। এগুলি তোমাদের ভাই জিনদের খাদ্য (মুসলিম হা/৪৫০)। উল্লেখ্য যে, ইবনু মাসউদ কর্তৃক আবুদাউদে বর্ণিত হাদীছে কয়লার কথাও বলা হয়েছে (আবুদাউদ হা/৩৯)।
ত্বায়েফ সফরের ঘটনাবলীতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব করলেন এবং সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে গিয়ে পুনরায় পথ চলতে শুরু করলেন। অতঃপর ‘নাখলা’ উপত্যকায় পৌঁছে সেখানকার জনপদে কয়েকদিন অবস্থান করলেন। এখানেই জিনদের প্রথম ইসলাম গ্রহণের ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটে। যা সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে এবং সূরা জিন ১-১৫ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তবে জিনদের কুরআন শ্রবণ ও ইসলাম গ্রহণের কথা তিনি তখনই জানতে পারেননি। বরং পরে সূরা জিন নাযিলের পর জানতে পারেন। অতঃপর সূরা আহক্বাফ ৩২ আয়াত নাযিল করে আল্লাহ তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, কোন শক্তিই তার দাওয়াতকে বন্ধ করতে পারবে না। যেখানে আল্লাহ বলেন যে ব্যক্তি আল্লাহর পথে আহবানকারীর ডাকে সাড়া দেয় না, সে ব্যক্তি এ পৃথিবীতে আল্লাহকে পরাজিত করতে পারবে না এবং আল্লাহ ব্যতীত সে কাউকে সাহায্যকারীও পাবে না। বস্তুতঃ তারাই হ’ল স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত” (আহক্বাফ ৪৬/৩২)। এতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মনের মধ্যে আরও শক্তি অনুভব করেন।
নাখলা উপত্যকায় ফজরের ছালাতে রাসূল (সাঃ)-এর কুরআন পাঠ শুনে নাছীরাইন  এলাকার নেতৃস্থানীয় জিনদের ৭ বা ৯জনের অনুসন্ধানী দলটি তাদের সম্প্রদায়ের নিকটে গিয়ে যে রিপোর্ট দেয়, সেখানে বক্তব্যের শুরুতে তারা কুরআনের অলৌকিকত্বের কথা বলে। যেমন “আমরা বিস্ময়কর কুরআন শুনেছি। যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। অতঃপর আমরা তার উপরে ঈমান এনেছি এবং আমরা আমাদের পালনকর্তার সাথে কাউকে কখনোই শরীক করব না’ (জিন ৭২/১-২)। অতঃপর তারা বলে, ‘আমরা নিশ্চিত যে, পৃথিবীতে আমরা আল্লাহকে পরাজিত করতে পারব না এবং তাঁর থেকে পালিয়েও বাঁচতে পারব না’ (জিন ৭২/১২)। সুহায়লী তাফসীরবিদগণের বরাতে বলেন, এই জিনগুলি ইহুদী ছিল। অতঃপর মুসলমান হয়’। এদের বক্তব্য এসেছে সূরা আহক্বাফ ২৯, ৩০ ও ৩১ আয়াতে’।
উপরোক্ত ঘটনায় প্রমাণিত হয় যে, শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) জিন ও ইনসানের নবী ছিলেন। বরং তিনি সকল সৃষ্ট জীবের নবী ছিলেন। যেমন তিনি বলেন, ‘আমি সকল সৃষ্ট জীবের প্রতি প্রেরিত হয়েছি এবং আমাকে দিয়ে নবীদের সিলসিলা সমাপ্ত করা হয়েছে’। অন্য হাদীছে সূরা সাবা ২৮ আয়াতের ব্যাখ্যায় ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন,  অতঃপর আল্লাহ তাকে জিন ও ইনসানের প্রতি প্রেরণ করেছেন’।
হযরত আয়েশা (রাঃ)-এর সাথে বিবাহ
একাদশ নববী বর্ষের শাওয়াল মাসে অর্থাৎ হযরত সওদা বিনতে যাম আর সাথে বিয়ের ঠিক এক বছরের মাথায় ওছমান বিন মাযউন (রাঃ)-এর স্ত্রী খাওলা বিনতে হাকীম (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে হযরত আবুবকরের নাবালিকা কন্যা আয়েশাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিবাহ করেন। বিয়ের তিন বছর পরে সাবালিকা হ’লে নয় বছর বয়সে মদীনায় ১ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে তিনি নবীগৃহে গমন করেন।
মে’রাজের তারিখ
এ সম্পর্কে বিদ্বানগণের মধ্যে ছয় প্রকার মতভেদ পরিদৃষ্ট হয়। যথা- (১) ১ নববী বর্ষেই মেরাজ সংঘটিত হয়েছিল (২) ৫ নববী বর্ষে (৩) ১০ নববী বর্ষের ২৭শে রজব তারিখে (৪) ১২ নববী বর্ষের রামাযান মাসে (৫) ১৩ নববী বর্ষের মুহাররম মাসে (৬) ১৩ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (আর-রাহীক্ব ১৩৭ পৃঃ)।
উপরোক্ত ছয়টি মতামতের মধ্যে প্রথম চারটি গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও তৃতীয় মতটিই উপমহাদেশে প্রচলিত আছে। কারণ, এ ব্যাপারে সকল বিদ্বান একমত যে, উম্মুল মুমেনীন হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয হওয়ার পূর্বেই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এটাও সকল বিদ্বান কর্তৃক স্বীকৃত যে, তাঁর মৃত্যু হয়েছিল ১০ নববী বর্ষের রামাযান মাসে। অতএব মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল তাঁর মৃত্যুর পরে একথা একপ্রকার নিশ্চিতভাবেই বলা চলে। এক্ষণে শেষের তিনটি মতামতের মধ্যে কোনটিতেই নিশ্চিত হবার উপায় নেই। তবে সূরা ইসরার শুরুতে মেরাজ সম্পর্কিত বর্ণনার পরপরই বনু ইস্রাঈলের অধঃপতন সম্পর্কিত বর্ণনায় প্রতীয়মান হয় যে, ঈমানী বিশ্বে বনু ইস্রাঈলের দীর্ঘ নেতৃত্বের অবসান এবং মুহাম্মাদী নেতৃত্বের উত্থান ঘটতে যাচ্ছে। অর্থাৎ হিজরতের প্রাক্কালে মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে মিরাজ সংঘটিত হয়েছিল। যা ১৩ নববী বর্ষের যেকোন এক রাতে হয়েছিল বলে একপ্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়। অতঃপর হিজরত শুরু হয়েছিল ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার।
মে’রাজের সঠিক তারিখ উম্মতের নিকটে অস্পষ্ট রাখার তাৎপর্য সম্ভবতঃ এই যে, তারা যেন ধ্বংসপ্রাপ্ত বিগত উম্মতগুলির ন্যায় অনুষ্ঠানসর্বস্ব না হয়ে পড়ে। বরং মে’রাজের তাৎপর্য অনুধাবন করে আখেরাতে জবাবদিহিতার ব্যাপারে নিশ্চিত বিশ্বাস রাখে। অতঃপর মেরাজের অমূল্য তোফা পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের মাধ্যমে গভীর অধ্যাত্ম চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সর্বদা আল্লাহর আনুগত্যের মাধ্যমে দুনিয়াবী জীবন পরিচালনা করে।
আল্লাহ ইচ্ছা করলে মক্কা থেকেই সরাসরি মে’রাজ করাতে পারতেন। কিন্তু মক্কা থেকে বায়তুল মুক্বাদ্দাস নিয়ে এসে সেখান থেকে মে’রাজ করানোর মধ্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত রয়েছে যে, ইবরাহীমী দাওয়াতের দু’টি প্রধান কেন্দ্র কা’বা ও বায়তুল মুক্বাদ্দাস দুই স্থানের কর্তৃত্ব ও দায়িত্ব এখন থেকে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর উম্মতের উপরেই ন্যস্ত করা হবে। যা ওমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ১৫ হিজরী সনে সম্পন্ন হয় এবং যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। যদিও পাশ্চাত্য বিশ্ব মধ্যপ্রাচ্যে তাদের সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাহির থেকে ইহুদীদের এনে ফিলিস্তীনের একাংশ থেকে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা মুসলমানদের বের করে দিয়েছে এবং সেখানে ইহুদীদের যবরদস্তি বসিয়ে দিয়ে তাকে ‘ইস্রাঈল রাষ্ট্র’ নাম দিয়েছে ১৯৪৮ সালে। নিঃসন্দেহে এটি একটি অস্থায়ী বিষয়। যার সত্বর অবসান হবে ইনশাআল্লাহ।
অতএব ইসলামী দাওয়াতের প্রথম পর্যায় মাক্কী জীবনের শেষপ্রান্তে এসে ইয়াছরিবে হিজরতের প্রাক্কালে মে’রাজ হয়েছিল বলা চলে। অর্থাৎ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত ১ম ও ২য় বায়আত অনুষ্ঠানের মধ্যবর্তী কোন এক রজনীতে মে’রাজ সংঘটিত হয়েছিল বলে প্রতীয়মান হয়। তবে আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
অতএব মে’রাজ ছিল ইসলামী বিজয়ের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত এবং মাদানী জীবনের নব অধ্যায়ের সূচক ঘটনা।
মাক্কী জীবন থেকে শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ
(১) কা’বাগৃহ ও মাসজিদুল হারামের রক্ষণাবেক্ষণকারী কুরায়েশ নেতার গৃহে জন্মগ্রহণকারী বিশ্বনবীকে তার বংশের লোকেরাই নবী হিসাবে মেনে নেননি। কারণ তারা এর মধ্যে তাদের নেতৃত্বের অবসান ও দুনিয়ারী স্বার্থের ক্ষতি বুঝতে পেরেছিলেন। সেকারণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হয়েও তারা মুমিন হ’তে পারেননি’ (বাক্বারাহ ২/৮)।
(২) নবী বংশের লোক হওয়া, আল্লাহর ঘর তৈরী করা ও তার সেবক হওয়া পরকালীন মুক্তির জন্য যথেষ্ট নয়। বরং সার্বিক জীবনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করা এবং আল্লাহর বিধান মেনে চলা ও তা প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোই হ’ল আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার পূর্বশর্ত’ (তওবাহ ৯/১৯-২০)।
(৩) আক্বীদায় পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত সমাজের কোন মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়। যেমন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)  নবী হওয়ার পূর্বে তরুণ বয়সে ‘হিলফুল ফুযূল’ নামক ‘কল্যাণ সংঘ’ প্রতিষ্ঠা করেন ও তাঁর সমাজ কল্যাণমূলক কার্যক্রমের জন্য সকলের প্রশংসাভাজন হন। তিনি ‘আল-আমীন’ উপাধিতে ভূষিত হন। কিন্তু তাতে সার্বিকভাবে সমাজের ও নেতৃত্বের মধ্যে কোন পরিবর্তন আসেনি।
(৪) সমাজের সত্যিকারের কল্যাণকামী ব্যক্তি নিজের চিন্তায় ও প্রচেষ্টায় যখন কোন কুল-কিনারা করতে পারেন না, তখন তিনি আল্লাহর নিকটে হেদায়াত প্রার্থনা করেন ও নিজেকে সম্পূর্ণরূপে তাঁর উপরে সমর্পণ করে দেন। অতঃপর আল্লাহর দেখানো পথেই তিনি অগ্রসর হন। হেরা গুহায় দিন-রাত আল্লাহর সাহায্য কামনায় রত মুহাম্মাদ বিন আব্দুল্লাহর মধ্যে আমরা সেই নিদর্শন দেখতে পাই। বর্তমান যুগে আর ‘অহি’ নাযিল হবে না। কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া কুরআন ও সুন্নাহ মুমিনকে সর্বদা জান্নাতের পথ দেখাবে।
(৫) রক্ত, বর্ণ, ভাষা, অঞ্চল প্রভৃতি জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান হ’লেও মূল উপাদান নয়। বরং ধর্মবিশ্বাস হ’ল জাতি গঠনের মূল উপাদান। আর সেকারণেই একই বংশের হওয়া সত্ত্বেও আৰু লাহাব ও আবু জাহল হয়েছিল রাসূল (ছাঃ)-এর রক্তপিপাসু দুশমন। অথচ ভিনদেশী ও ভিন রঙ-বর্ণ ও অঞ্চলের লোক হওয়া সত্ত্বেও ছুহায়ের রূমী ও বেলাল হাবশী হয়েছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর বন্ধু। সেকারণ মযবুত সংগঠনে ও জাতি গঠনে আক্বীদাই হ’ল সবচেয়ে বড় উপাদান।
(৬) আল্লাহর পথের পথিকগণ শত নির্যাতনেও আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত হন না। জান্নাতের বিনিময়ে তারা দুনিয়াবী কষ্ট ও দুঃখকে তুচ্ছ জ্ঞান করেন। মক্কার নির্যাতিত অসহায় মুসলমানদের অবস্থা বিশেষ করে বেলাল, খাববার ও ইয়াসির পরিবারের লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনী যেকোন মানুষকে তাড়িত করে।
(৭) ইসলামী আন্দোলনের নিবেদিতপ্রাণ নেতৃবৃন্দ সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর উপর ভরসা করেন এবং ইসলামের স্বার্থে প্রয়োজন বোধ করলে আল্লাহ তাদের রক্ষা করেন। যেমন হিজরতের পথে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে রক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন, মুমিনদের রক্ষা করাই তাঁর কর্তব্য’ (রূম ৩০/৪৭: ইউনুস ১০/১০৩)।
(৮) কায়েমী স্বার্থবাদী নেতৃত্ব কখনোই সংস্কারের বাণীকে সহ্য করতে পারে না। তারা অহংকারে ফেটে পড়ে এবং নিজেদের চালু করা মনগড়া রীতি-নীতির উপরে যিদ ও হঠকারিতা করে’ (বাক্বারাহ ২/২০৬)। যেমন ইতিপূর্বে মুসার বিরুদ্ধে ফেরাউন তার লোকদের বলেছিল, আমি তোমাদেরকে কেবল কল্যাণের পথই দেখিয়ে থাকি” (মুমিন/ গাফের ৪০/২৯)। অথচ তা ছিল জাহান্নামের পথ এবং মূসার পথ ছিল জান্নাতের পথ।
                                                                                                                    মাক্কী জীবন সমাপ্ত
                                                                                                                   تمت الحياة المكية بالخير

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *