হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) – মাদানী জীবন

হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) – মাদানী জীবন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাদানী জীবন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)–এর মাদানী জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে।
এক. ১ম হিজরী সনের ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে সেপ্টেম্বর সোমবার হ’তে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলকাদাহ মাসে অনুষ্ঠিত হোদায়বিয়ার সন্ধি পর্যন্ত প্রায় ছয় বছর। এই সময় কাফের ও মুনাফিকদের মাধ্যমে ভিতরে ও বাইরের চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ও সশস্ত্র হামলা সমূহ সংঘটিত হয়। ইসলামকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য এ সময়ের মধ্যে সর্বমোট ৫০টি ছোট-বড় যুদ্ধ ও অভিযান সমূহ পরিচালিত হয়।
দুই. মক্কার মুশরিকদের সাথে সন্ধি চলাকালীন সময়। যার মেয়াদকাল ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বাদাহ হাতে ৮ম হিজরীর রামাযান মাসে মক্কা বিজয় পর্যন্ত প্রায় দু’বছর। এই সময়ে প্রধানতঃ ইহুদী ও তাদের মিত্রদের সাথে বড়-ছোট ২২টি যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
তিন. ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয়ের পর হাতে ১১ হিজরীতে রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত প্রায় তিন বছর। এই সময়ে দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। চারদিক থেকে গোত্রনেতারা প্রতিনিধিদল নিয়ে মদীনায় এসে ইসলাম গ্রহণ করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-বিদেশী রাজন্যবর্গের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে দূত মারফত পত্র প্রেরণ করেন। এ সময় হোবল, লাত, মানাত, “উযযা, সুওয়া’ প্রভৃতি প্রসিদ্ধ মূর্তিগুলি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। এই সময়ে হোনায়েন যুদ্ধ এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে তাবুক যুদ্ধে গমন ও সর্বশেষ সারিইয়া উসামা প্রেরণ সহ মোট ১৮টি মিলে মাদানী জীবনের ১০ বছরে ছোট-বড় প্রায় ৯০টি যুদ্ধ ও অভিযানসমূহ পরিচালিত হয়। অবশেষে সব বাধা অতিক্রম করে ইসলাম রাষ্ট্রীয় রূপ পরিগ্রহ করে এবং তৎকালীন বিশ্বের পরাশক্তি সমূহকে চ্যালেঞ্জ করে টিঁকে থাকার মত শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়।
এক্ষণে আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হিজরত কালীন সময়ে মদীনার সামাজিক অবস্থা ও সে প্রেক্ষিতে রাসুল (সাঃ)- এর গৃহীত কার্যক্রমসমূহ একে একে আলোচনা করব।
মদীনার সামাজিক অবস্থা
খ্রিষ্টীয় ৭০ সালে প্রথমবার এবং ১৩২-৩৫ সালে দ্বিতীয়বার খ্রিষ্টান রোমকদের হামলায় বায়তুল মুক্বাদ্দাস অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হয়ে ইহুদীরা ইয়াছরিব ও হিজায অঞ্চলে হিজরত করে (সীরাহ ছহীহাহ ১/২২৭)। মিষ্ট পানি, উর্বর অঞ্চল এবং শামের দিকে ব্যবসায়ী পথের গুরুত্বের কারণে ইহুদী বনু নাযীর ও বনু কুরায়যা গোত্রদ্বয় ইয়াছরিবের
পূর্ব অংশ হাররাহ  ( এলাকায় বসতি স্থাপন করে। তাদের অপর গোত্র বনু ক্বায়নুক্কা ইয়াছরিবের নিম্নভূমিতে বসতি স্থাপন করে। বনু ক্বায়নুকার শাখা গোত্রসমূহের আরবী নাম দেখে তাদেরকে আরব থেকে ধর্মান্তরিত ইহুদী বলে ঐতিহাসিকগণের অনেকে মত প্রকাশ করেছেন। যেমন বন্ধু ইকরিমা, বনু মুআবিয়া, বনু আওফ, বনু ছা’লাবাহ প্রভৃতি নাম সমূহ। উপরোক্ত তিনটি প্রধান গোত্র ছাড়াও ছোট ছোট বিশটির অধিক ইহুদী শাখা গোত্রসমূহ ইয়াছরিবের বিভিন্ন অঞ্চলে এ সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
অন্যদিকে আউস ও খাযরাজ, যারা ইসমাঈল-পুত্র নাবেত এর বংশধর ছিল এবং ইয়ামনের আমদ গোত্রের দিকে সম্পর্কিত ছিল, তারা খ্রিষ্টীয় ২০৭ সালের  দিকে ইয়ামন থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইয়াছরিবে হিজরত করে। সেখানে পূর্ব থেকেই অবস্থানরত ইহুদীরা তাদেরকে ইয়াছরিবের অনুর্বর ও পরিত্যক্ত এলাকায় বসবাস করতে বাধ্য করে। আউসরা বনু নাযীর ও বনু কুরায়যার প্রতিবেশী হয় এবং খাযরাজরা বনু ক্বায়নুক্কার প্রতিবেশী হয়। আউসদের এলাকা খাযরাজদের এলাকার চাইতে অধিকতর উর্বর ছিল। ফলে তাদের মধ্যে নিয়মিত হানাহানি ও যুদ্ধ-বিগ্রহের এটাও একটা কারণ ছিল। ইহুদীরা উভয় গোত্রের উপর কর্তৃত্ব করত। তারা উভয় দলের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে দিত। আবার উভয় দলের মধ্যে সন্ধি করে দিত। তাদের মধ্যকার সবচেয়ে বড় ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল হিজরতের পাঁচ বছর পূর্বে সংঘটিত বু’আছ যুদ্ধ। যাতে আউসরা খাযরাজদের উপর জয়লাভ করে। কিন্তু উভয় গোত্র সর্বদা পুনরায় পরস্পরের মধ্যে যুদ্ধের আশংকা করত। ফলে তারা নিজেদের মধ্যে মৈত্রী স্থাপন করে এবং উভয় গোত্রের ঐক্যমতে আব্দুল্লাহ বিন উবাই খাযরাজীকে তাদের নেতা নির্বাচন করে। এমতাবস্থায় আখেরী নবীর শুভাগমনে তারা উৎফুল্ল হয় এবং নিজেদের মধ্যকার সব তিক্ততা ভুলে শেষনবী (সাঃ)-কে স্বাগত জানাবার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। যেমন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, ব্লু’আছ যুদ্ধের দিনটিকে আল্লাহ তাঁর রাসূলের আগমনের এবং ইয়াছরিব বাসীদের ইসলামে প্রবেশের অগ্রিম দিবস’  হিসাবে নির্ধারণ করেছিলেন।
উল্লেখ্য যে, আউস ও খাযরাজ ছিলেন আপন দুই ভাই এবং ইসমাঈল-পুত্র নাবেত-এর বংশধর। যারা উত্তর হেজায শাসন করতেন। কিন্তু মালেক বিন আজলান খাযরাজীর গোলাম হুর বিন সুমাইরকে হত্যার কারণে তাদের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়। যা প্রায় ১২০ বছর যাবৎ চলে। পরে তারা ইয়াছরিবে হিজরত করেন। সেখানে তাদের মধ্যে সর্বশেষ বুআছ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। যার পাঁচ বছর পর রাসূল (ছাঃ)-এর হিজরতের মাধ্যমে ইসলামের বরকতে উভয় দলের মধ্যে দীর্ঘকালীন যুদ্ধের আগুন নির্বাপিত হয় এবং তারা পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে যায়। যে বিষয়ে সূরা আলে ইমরান ১০৩ আয়াত নাযিল হয় (তাফসীর তাবারী হা/১৪৭৩, ৭৫৮৯; তাফসীর ইবনু কাছীর)।
২০৭ খ্রিষ্টাব্দে একই সময় বন্ধু খোষা আহ গোত্র ইয়ামন থেকে হিজরত করে মক্কার নিকটবর্তী মারুম যাহরানে বসতি স্থাপন করে। যারা পরবর্তীকালে মক্কার শাসন ক্ষমতা লাভ করে এবং দীর্ঘদিন উক্ত ক্ষমতায় থাকে। অবশেষে তাদের জামাতা কুরায়েশ নেতা কুছাই বিন কিলাব মক্কার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। জামাতার বংশ হিসাবে বনু খোয়া আহ সর্বদা বনু হাশেমকে সহযোগিতা করেছে। যা মক্কা বিজয় ও তার পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল।
মক্কা ও মদীনার সামাজিক অবস্থার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কার সমাজ ব্যবস্থাপনায় কুরায়েশদের একক প্রভুত্ব ছিল। ধর্মীয় দিক দিয়ে তাদের অধিকাংশ মূর্তিপূজারী ছিল। যদিও সবাই আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী ছিল। হজ্জ ও ওমরাহ করত। ইবরাহীম (আঃ)-এর দ্বীনের উপরে কায়েম আছে বলে তারা নিজেদেরকে ‘হানীফ বা “আল্লাহর প্রতি একনিষ্ঠ’ বলে দাবী করত। বিগত নেককার লোকদের মূর্তির অসীলায় তারা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করত। এই অসীলাপূজার কারণেই তারা মুশরিক জাতিতে পরিণত হয়েছিল এবং তাদের রক্ত হালাল গণ্য হয়েছিল। তারাও রাসূল (সাঃ)-এর প্রচারিত নির্ভেজাল তাওহীদকে তাদের কপট ধর্ম বিশ্বাস ও দুনিয়াবী স্বার্থের বিরোধী সাব্যস্ত করে রাসূল (সাঃ)-এর ও মুসলমানদের রক্তকে হালাল গণ্য করেছিল। মক্কায় মুসলমানরা ছিল দুর্বল ও মযলূম এবং বিরোধী কুরায়েশ নেতারা ছিল প্রবল ও পরাক্রমশালী।
পক্ষান্তরে মদীনায় সমাজ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে কারু একক নেতৃত্ব ছিল না। ধর্মীয় দিক দিয়েও তারা এক ছিল না বা বংশধারার দিক দিয়েও এক ছিল না। সর্বশেষ বুআছের যুদ্ধে বিপর্যস্ত আউস ও খাযরাজ প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করেন। এর দ্বারা মদীনাবাসীদের আন্তরিক কামনা ছিল যে, তাঁর আগমনের মাধ্যমে তাদের মধ্যকার দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটবে। ফলে এখানে রাসূল (সাঃ) ও মুহাজিরগণ ছিলেন শুরু থেকেই কর্তৃত্বের অধিকারী।
মাক্কী ও মাদানী জীবনের প্রধান পার্থক্য সমূহ
মাক্কী ও মাদানী জীবনের মধ্যে প্রধান পার্থক্য ছিল এই যে, মক্কায় জন্মস্থান হ’লেও রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানগণ সেখানে ছিলেন দুনিয়াবী শক্তির দিক দিয়ে দুর্বল ও নির্যাতিত। পক্ষান্তরে মাদানী জীবনের প্রথম থেকেই নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের বাগডোর ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদের হাতে। এখানে বিরোধীরা স্থানীয় হ’লেও তারা ছিল নিষ্প্রভ। ফলে মদীনার অনুকূল সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে ইসলামকে পূর্ণতা দানের সুযোগ আসে। আর সেকারণেই ইসলামের যাবতীয় হারাম-হালাল ও আর্থ সামাজিক বিধি-বিধান একে একে মাদানী জীবনে অবতীর্ণ হয় ও তা বাস্তবায়িত হয়। অতঃপর বিদায় হজ্জের সময় আল্লাহর পক্ষ হ’তে পূর্ণতার সনদ হিসাবে আয়াত নাযিল হয়  আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করলাম এবং তোমাদের উপরে আমার অনুগ্রহকে সম্পূর্ণ করে দিলাম ও তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)৷ বিদায় হজ্জের সময় ১০ম হিজরীর ৯ই যিলহাজ্জ শুক্রবার মাগরিবের পূর্বে মক্কায় আরাফা ময়দানে অবস্থানকালে এ আয়াত নাযিল হয়। এর মাত্র ৮৩ দিন পর ১১ হিজরীর ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার মদীনায় রাসূল (সাঃ) মৃত্যু বরণ করেন।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, অত্র আয়াত নাযিলের পর বিধি-বিধান সম্পর্কিত আর কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তবে উৎসাহ প্রদান ও ভীতি প্রদর্শন মূলক কয়েকটি মাত্র আয়াত নাযিল হয়। এভাবে আদি পিতা আদম (আঃ) থেকে আল্লাহর পক্ষ হ’তে সত্য দ্বীন নাযিল হওয়ার যে সিলসিলা জারী হয়েছিল, শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মাধ্যমে মদীনায় তার পরিসমাপ্তি ঘটে এবং আল্লাহ প্রেরিত ইলাহী বিধানের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হয়। ফালিল্লা-হিল হাম্দ।
ইহুদীদের কপট চরিত্র
হিজরতের পূর্ব থেকেই ইহুদীরা মক্কায় রাসূল (সাঃ)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে জানত। এখন যখন তিনি মদীনায় হিজরত করে এলেন এবং মানুষের পারস্পরিক ব্যবহার, লেন দেন, ব্যবসা-বাণিজ্য সকল ক্ষেত্রে বিশ্বস্ততা ও পবিত্রতার পথ অবলম্বন করলেন। যার ফলে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ও হিংসা-হানাহানিতে বিপর্যস্ত ইয়াছরিবের গোত্র সমূহের মধ্যকার শীতল সম্পর্ক ক্রমেই উষ্ণ, মধুর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে লাগল, তখন তা ইহুদীদের মনে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করল। তাদের আশংকা হ’ল যে, এইভাবে যদি সবাই মুসলমান হয়ে যায় ও আপোষে ভাই ভাই হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়ে যায়, তাহলে তাদের বিভক্ত কর ও শোষণ করা নীতি মাঠে মারা যাবে। এর ফলে তাদের সামাজিক নেতৃত্ব খতম হয়ে যাবে। সাথে সাথে ইসলামে সূদ হারাম হওয়ার কারণে তাদের রক্তচোষা সুদী কারবার একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে, যা তাদের পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধ্বস নামাবে। এমনকি চক্রবৃদ্ধি হারে ফেঁপে ওঠা সূদের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার কারণে অত্যাচারমূলক চুক্তির ফলে ইয়াছরিব বাসীদের যে বিপুল ধন-সম্পদ তারা কুক্ষিগত করেছিল, তার সবই তাদেরকে ফেরৎ দিতে বাধ্য হ’তে হবে। ফলে তারা রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে গোপনে শত্রুতা শুরু করে দেয়। পরে যা প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। তাদের কপট চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ রাসূল (সাঃ)-এর মদীনায় পদার্পণের প্রথম দিনেই ঘটে। নিম্নের দু’টি ঘটনা তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
দু’টি দৃষ্টান্ত
(১) আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব-এর আগমন  রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় আগমনের পর প্রথম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা আবু ইয়াসির বিন আখত্বাব। তিনি তার লোকদের নিকট ফিরে গিয়ে বলেন, ‘তোমরা আমার আনুগত্য কর। কেননা ইনিই সেই নবী আমরা যার অপেক্ষায় ছিলাম’। কিন্তু হুয়াই বিন আখত্বাব, যিনি তার ভাই ও গোত্রের নেতা ছিলেন, তার বিরোধিতার কারণে সাধারণ ইহুদীরা ইসলাম কবুল করা হাতে বিরত থাকে।
উল্লেখ্য যে, ইহুদী আলেম ও সমাজনেতাদের সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছিলেন, ‘যদি আমার উপরে দশজন ইহুদী নেতা ঈমান আনত, তাহ’লে গোটা ইহুদী সম্প্রদায় আমার উপরে ঈমান আনতো’ এতে বুঝা যায় যে, সমাজনেতা ও আলেমগণের দায়িত্ব সর্বাধিক। অতএব তাদের সাবধান হওয়া কর্তব্য।
(২) আব্দুল্লাহ বিন সালাম-এর ইসলাম গ্রহণে প্রতিক্রিয়া: কোবার পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন ইয়াছরিবে তাঁর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বন্ধু নাজ্জার গোত্রে অবতরণ করেন, তখন সেখানে গিয়ে উপস্থিত হ’লেন ইহুদীদের সবচেয়ে বড় আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম। তিনি ছিলেন বনু কায়কা ইহুদী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত (আবুদাউদ হা/৩০০৫)। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে এমন কিছু প্রশ্ন করলেন, যার উত্তর নবী ব্যতীত কারু পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়। সব প্রশ্নের সঠিক জবাব পেয়ে তিনি সাথে সাথে মুসলমান হয়ে গেলেন। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-কে সাবধান করে দিলেন এই বলে যে, এ ইহুদীরা হ’ল মিথ্যা অপবাদ দানকারী এক ঘূর্ণিত সম্প্রদায়। আপনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করার আগেই যদি তারা আমার ইসলাম গ্রহণ করার বিষয়টি জেনে ফেলে, তাহ’লে তারা আপনার নিকটে আমার সম্পর্কে মিথ্যা অপবাদ দিবে। তখন তিনি আব্দুল্লাহকে পাশেই আত্মগোপন করতে বলে ইহুদীদের ডেকে পাঠালেন। তারা এলে তিনি তাদের নিকটে আব্দুল্লাহ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তারা বলল আমাদের নেতা এবং আমাদের নেতার পুত্র। আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি এবং আমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির পুত্রা। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমাদের মধ্যে সেরা জ্ঞানী ও সেরা জ্ঞানীর পুত্র’ (বুখারী হা/৩৯১১)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)বললেন, ‘আচ্ছা যদি আব্দুল্লাহ মুসলমান হয়ে যায় ? জবাবে তারা দু’বার বা তিনবার বলল, ‘আল্লাহ তাকে এ থেকে রক্ষা করুন। অতঃপর আব্দুল্লাহ বিন সালাম গোপন স্থান থেকে বেরিয়ে এসে উচ্চকণ্ঠে কালেমা শাহাদাত পাঠ করলেন। এটা শোনামাত্র ইহুদীরা বলে উঠলো আমাদের সবচেয়ে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ও নিকৃষ্ট ব্যক্তির পুত্র’। আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) তখন তাদেরকে বললেন, ‘হে ইহুদী সম্প্রদায়! আল্লাহকে ভয় কর। আল্লাহর কসম, যিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, তোমরা ভালভাবেই জানো যে, ইনি আল্লাহর রাসূল এবং ইনি সত্যসহ আগমন করেছেন’। জবাবে তারা বলল, ‘তুমি মিথ্যা বলছ’।বলা বাহুল্য এটাই ছিল ইহুদীদের সম্পর্কে রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম তিক্ত অভিজ্ঞতা, যা তিনি মদীনায় পদার্পণের শুরুতেই অর্জন করেন।
আজকেও ইহুদী-নাছারাদের উক্ত বদস্বভাব অব্যাহত আছে। তাদের মিডিয়াগুলি রাসূল (সাঃ) ও ইসলামের বিরুদ্ধে সর্বদা লাগামহীনভাবে অপপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। সেদিন যেমন মদীনার মুনাফিকরা ইহুদীদের দোসর ছিল, আজও তেমনি মুসলিম নামধারী বস্তুবাদীরা তাদের দোসর হিসাবে কাজ করছে।
ইসলামী সমাজ ব্যবস্থার গোড়াপত্তন
পূর্বোক্ত সামগ্রিক অবস্থা সম্মুখে রেখে এক্ষণে আমরা মদীনায় নতুন সমাজ ব্যবস্থার রূপায়ণ প্রত্যক্ষ করব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে একই সঙ্গে আভ্যন্তরীণ সংশোধন ও বাইরের অবস্থা সামাল দিয়ে চলতে হয়েছে। নতুন জাতি গঠনের প্রধান ভিত্তি হ’ল আধ্যাত্মিক কেন্দ্র স্থাপন। সেজন্য তিনি ক্বোবায় প্রথম মসজিদ নির্মাণের পর এবার মদীনায় প্রধান মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন।
মসজিদে নববী নির্মাণ
মদীনায় প্রবেশ করে রাসূল (সাঃ)-এর উটনী যে স্থানে প্রথম বসে পড়েছিল, সেই স্থানটিই হ’ল পরবর্তীতে মসজিদে নববীর দরজার স্থান। স্থানটির মালিক ছিল দু’জন ইয়াতীম বালক সাহল ও সোহায়েল বিন রাফে’ বিন আমর। এটি তখন তাদের খেজুর শুকানোর চাতাল ছিল (ইবনু হিশাম ১/৪৯৫)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দশ দীনার মূল্যে স্থানটি খরীদ করলেন। আবুবকর (রাঃ) মূল্য পরিশোধ করলেন।অতঃপর তার আশপাশের মুশরিকদের কবরগুলি উঠিয়ে ফেলা হয় এবং ভগ্নস্তূপগুলি সরিয়ে স্থানটি সমতল করা হয়। গারক্বাদের খেজুর গাছগুলি উঠিয়ে সেগুলিকে ক্বিবলার দিকে সারিবদ্ধভাবে পুঁতে দেওয়া হয়’ (বুখারী হা/৪২৮)। অতঃপর খেজুর গাছ ও তার পাতা দিয়ে মসজিদ তৈরী হয়। চার বছর পর এটি কাঁচা ইট দিয়ে নির্মাণ করা হয়। ঐ সময় আল্লাহর হুকুমে ক্বিবলা ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস, যা ছিল ইহুদীদের ক্বিবলা এবং মদীনা থেকে উত্তর দিকে। মসজিদের ভিত ছিল প্রায় তিন হাত উঁচু। দরজা ছিল তিনটি। যার দু’বাহুর স্তম্ভগুলি ছিল পাথরের, মধ্যের খাম্বাগুলি খেজুর বৃক্ষের, দেওয়াল কাঁচা ইটের, ছাদ খেজুর পাতার এবং বালু ও ছোট কংকর বিছানো মেঝে- এই নিয়ে তৈরী হ’ল মসজিদে নববী, যা তখন ছিল ৭০×৬০×৫ হাত মোট ৪২০০ বর্গ হাত আয়তন বিশিষ্ট। যেখানে বর্ষায় বৃষ্টি পড়ত। ১৬ বা ১৭ মাস পরে ক্বিবলা পরিবর্তিত হ’লে উত্তর দেওয়ালের বদলে দক্ষিণ দেওয়ালের দিকে ক্বিবলা ঘুরে যায়। ফলে পিছনে একমাত্র দরজাটিই এখন ক্বিবলা হয়েছে। কেননা মক্কা হ’ল মদীনা থেকে দক্ষিণ দিকে।
“উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন, আনছারগণ মাল জমা করে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদিয়ে আপনি মসজিদটি আরও সুন্দরভাবে নির্মাণ করুন। কতদিন আমরা এই ছাপড়ার নীচে ছালাত আদায় করব? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বলেন ‘আমার ভাই মূসার ছাপড়ার ন্যায় ছাপড়া থেকে ফিরে আসতে আমার কোন আগ্রহ নেই’।
আযানের প্রবর্তন
মসজিদ নির্মিত হওয়ার পর মুছল্লীদের পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আহবানের জন্য পরামর্শসভা বসে। ছাহাবীগণ বিভিন্ন পরামর্শ দেন। কিন্তু কোনরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক স্থগিত হয়ে যায়। পরদিন আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন আব্দে রবিবহী (রাঃ) প্রথমে এসে রাসূল (সাঃ)-কে বর্তমান আযানের শব্দ সমূহ সহ স্বপ্নবৃত্তান্ত শুনালে তিনি তার সত্যায়ন করেন। অতঃপর উচ্চকণ্ঠের অধিকারী বেলালকে আযান দেওয়ার নির্দেশ দেন। আযানের ধ্বনি শুনে কাপড় ঘেঁষতে ঘেঁষতে ওমর (রাঃ) দৌড়ে এসে বললেন ‘হে আল্লাহর রাসূল! যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, সেই আল্লাহর কসম করে বলছি, আমিও একই স্বপ্ন দেখেছি’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ফালিল্লা-হিল হামদ ‘আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা’। একটি বর্ণনা মতে ঐ রাতে ১১ জন ছাহাবী একই আযানের স্বপ্ন দেখেন’। উল্লেখ্য যে, ওমর ফারূক (রাঃ) ২০ দিন পূর্বে উক্ত স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ আগেই বলেছে দেখে লজ্জায় তিনি নিজের কথা প্রকাশ করেননি।
বলা বাহুল্য, এই আযান কেবল ধ্বনি মাত্র ছিল না। বরং এ ছিল শিরকের অমানিশা ভেদকারী আপোষহীন তাওহীদের এক দ্ব্যর্থহীন আহবান। যা কেবল সে যুগে মদীনার মুশরিক ও ইহুদী-নাছারাদের হৃদয়কে ভীত-কম্পিত করেনি, বরং যুগে যুগে প্রতিষ্ঠিত শিরকী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এ ছিল তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ বিপ্লবের উদাত্ত ঘোষণা। এ আযান যুগে যুগে প্রত্যেক আল্লাহপ্রেমীর হৃদয়ে এনে দেয় এক অনন্য প্রেমের অনবদ্য মূর্ছনা। যার আহবানে সাড়া দিয়ে মুমিন পাগলপারা হয়ে ছুটে চলে মসজিদের পানে। লুটিয়ে পড়ে সিজদায় স্বীয় প্রভুর সকাশে। তনুমন ঢেলে দিয়ে প্রার্থনা নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে। বাংলার কবি কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১ খৃ.) তাই কত সুন্দরই না গেয়েছেন
                                         কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি
                                          মর্মে মর্মে সেই সুর বাজিল কি সুমধুর

                                          আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমনী

                                         কে ঐ শুনালো মোরে আযানের ধ্বনি’
ইহুদীদের বাঁশি, নাছারাদের ঘণ্টাধ্বনি ও পৌত্তলিকদের বাদ্য-বাজনার বিপরীতে মুসলমানদের আযান ধ্বনির মধ্যেকার পার্থক্য আসমান ও যমীনের পার্থক্যের ন্যায়। আযানের মধ্যে রয়েছে ধ্বনির সাথে বাণী, রয়েছে হৃদয়ের প্রতিধ্বনি, রয়েছে তাওহীদের বিচ্ছুরণ এবং রয়েছে আত্মনিবেদন ও আত্মকল্যাণের এক হৃদয়ভেদী অনুরণন। এমন বহুমুখী অর্থবহ মর্মস্পর্শী ও সুউচ্চ আহবানধ্বনি পৃথিবীর কোন ধর্মে বা কোন জাতির মধ্যে নেই। ১ম হিজরী সনে আযান চালু হওয়ার পর থেকে অদ্যাবধি তা প্রতি মুহূর্তে ধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর দিকে দিকে অবিরামভাবে অপ্রতিহত গতিতে। আহ্নিক গতির কারণে ঘূর্ণায়মান পৃথিবীর প্রতি স্থানে সর্বদা ছালাতের সময়ের পরিবর্তন হচ্ছে। সেই সাথে পরিবর্তন হচ্ছে আযানের সময়ের। ফলে পৃথিবীর সর্বত্র সর্বদা প্রতিটি মিনিটে ও সেকেন্ডে আযান উচ্চারিত হচ্ছে। আর সেই সাথে ধ্বনিত হচ্ছে তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্যবাণী এবং উচ্চকিত হচ্ছে সর্বত্র আল্লাহর মহত্ত্ব ও বড়ত্বের অনন্য ধ্বনি। যার সাক্ষী হচ্ছে প্রতিটি সজীব ও নির্জীব বস্তু ও প্রাণী। এমনকি পানির মধ্যে বিচরণকারী মৎস্যকুল। মানুষ যদি কখনো এ আহবানের মর্ম বুঝে এগিয়ে আসে, তবে পৃথিবী থেকে দূর হয়ে যাবে সকল প্রকার শিরকী জাহেলিয়াতের গাঢ় অমানিশা। টুটে যাবে মানুষের প্রতি মানুষের দাসত্ব নিগড়। প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর গোলামীর অধীনে সকল মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা। শৃংখলমুক্ত হবে সত্য, ন্যায় ও মানবতা। আযান তাই সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নিরংকুশ উলূহিয়াতের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা। বিশ্বমানবতার একক চেতনা ও কল্যাণের হৃদয়স্রাবী দ্যোতনা।
আহলে ছুফফাহ
মক্কা থেকে আগত মুহাজিরগণ মদীনায় এসে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতেন। অতঃপর মসজিদে নববী নির্মাণ শেষে তার পিছনে একটি ছাপড়া দেওয়া হয়। যেখানে নিরাশ্রয় মুহাজিরগণ এসে বসবাস করতেন। ছুফফাহ’ অর্থ ছাপড়া। যা দিয়ে ছায়া করা হয়। এভাবে মুহাজিরগণই ছিলেন আহলে ছুফফার প্রথম দল। যাঁদেরকে বলা হ’ত (আবুদাউদ হা/৪০০৩)। এছাড়া অন্যান্য স্থান হ’তেও অসহায় মুসলমানরা এসে এখানে সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতেন (আহমাদ হা/১৬০৩১)। পরবর্তীতে কোন ব্যবস্থা হয়ে গেলে তারা সেখানে চলে যেতেন। এখানে সাময়িক আশ্রয় গ্রহণকারীগণ ইতিহাসে ‘আহলে ছুফফাহ’ বা ‘আছহাবে ছুফফাহ’ নামে খ্যাতি লাভ করেন। বিখ্যাত হাদীছবেত্তা ছাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) এখানকার অন্যতম সদস্য ও দায়িত্বশীল ছিলেন। যিনি ওমর (রাঃ)-এর যুগে বাহরায়েন এবং মুআবিয়া (রাঃ) ও মারওয়ানের সময় একাধিকবার মদীনার গবর্ণর নিযুক্ত হন। তিনি ৫৭ হিজরীতে ৭৮ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।
অনেক সময় মদীনার ছাহাবীগণও ‘যুদ্ধ’ ও দুনিয়াত্যাগী জীবন যাপনের জন্য তাদের মধ্যে এসে বসবাস করতেন। যেমন কা’ব বিন মালেক আনছারী, হানযালা বিন আবু ‘আমের ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’, হারেছাহ বিন নুমান আনছারী প্রমুখ। চাতালটি যথেষ্ট বড় ছিল। কেননা এখানে যয়নব বিনতে জাহশের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর বিবাহের ওয়ালীমা খানায় প্রায় তিনশ’র মত মানুষ জমা হয়েছিলেন। তাদের সংখ্যা কম-বেশী হ’ত। তবে সাধারণতঃ সর্বদা ৭০ জনের মত থাকতেন। কখনো অনেক বেড়ে যেত। খাযরাজ নেতা সাদ বিন ওবাদাহ (রাঃ) একবার তাদের মধ্যে থেকে একাই আশি জনকে মেহমানদারী করেছিলেন।
আনছার ও মুহাজিরগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব বন্ধন
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আনাস বিন মালেকের গৃহে আনছার ও মুহাজিরদের নেতৃস্থানীয় ৯০ জন ব্যক্তির এক আনুষ্ঠানিক বৈঠক আহবান করেন। যেখানে উভয় দলের অর্ধেক অর্ধেক সদস্য উপস্থিত ছিলেন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের পরস্পর দু’জনের মধ্যে ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বন্ধন স্থাপন করেন এই শর্তে যে, ‘তারা একে অপরের দুঃখ-বেদনার সাথী হবেন এবং মৃত্যুর পরে পরস্পরের সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হবেন’। তবে উত্তরাধিকার লাভের শর্তটি ২য় হিজরীতে বদর যুদ্ধের পর অবতীর্ণ আয়াতের মাধ্যমে রহিত হয়ে যায়। যেখানে বলা হয়, রক্ত সম্পর্কিত আত্মীয়গণ আল্লাহর কিতাবে পরস্পরের অধিক হকদার। নিশ্চয়ই আল্লাহ সকল বিষয়ে অধিক জ্ঞাত’ (আনফাল ৮/৭৫)। এর ফলে উত্তরাধিকার লাভের বিষয়টি রহিত হ’লেও তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ছিল অটুট এবং অনন্য। বিশ্ব ইতিহাসে যার কোন তুলনা নেই। ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের এই ঘটনা ১ম হিজরী সনেই ঘটেছিল মসজিদে নববী নির্মাণকালে অথবা নির্মাণ শেষে। তবে ঠিক কোন তারিখে ঘটেছিল, সেটা সঠিকভাবে জানা যায় না। ইবনু আব্দিল বার্র এটিকে হিজরতের ৫ মাস পরে বলেছেন। ইবনু সা’দ এটিকে হিজরতের পরে এবং বদর যুদ্ধের পূর্বে বলেছেন (সীরাহ ছহীহাহ ১/২৪৩)। কয়েকটি দৃষ্টান্ত নিম্নে প্রদত্ত হ’ল।
ইসলামে জিহাদ বিধান  
‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হাল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হাল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
(ক) মাক্কী জীবনে কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। বলা হয়েছিল, । এই তোমরা হস্ত সংযত রাখ এবং ছালাত আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর’… (নিসা ৪/৭৭)। এই নীতি সর্বদা প্রযোজ্য। যখন কুফরী শক্তি প্রবল হবে এবং ইসলামী শক্তি তার তুলনায় দুর্বল থাকবে।
(খ) অতঃপর দেশ থেকে বা গৃহ থেকে বিতাড়িত হওয়ার মত চূড়ান্ত যুলুমের অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে। বলা হয়  যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হ’ল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে সক্ষমা (হাজ 22/৩৯)।
(গ) এ সময় কেবল যুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়, আর তোমরা লড়াই কর আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে, যারা লড়াই করে তোমাদের বিরুদ্ধে এবং এতে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)। অর্থাৎ স্রেফ পরকালীন স্বার্থেই জিহাদ হবে, দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয় এবং যারা যুদ্ধ করে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।
(ঘ) যুদ্ধকালে নির্দেশ দেওয়া হয়, । তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’ ।
(ঙ) অতঃপর কুফরী শক্তির সর্বব্যাপী হামলা থেকে দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে মৌলিক নির্দেশনা জারী করা হয়, “আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফেৎনার (কুফরীর) অবসান হয় এবং আনুগত্য স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয়, তবে যালেমদের ব্যতীত অন্যদের প্রতি কোন প্রতিশোধ নেই’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩; আনফাল ৮/৩৯)।
(চ) সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় তাওহীদের ঝান্ডা উঁচু থাকবে ও শিরকের ঝান্ডা অবনমিত হবে’ মর্মে জিহাদের চিরন্তন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, এবং তিনি কাফেরদের (শিরকের) ঝান্ডা অবনত করে দিলেন ও আল্লাহর (তাওহীদের) ঝান্ডা সমুন্নত রাখলেন। বস্তুতঃ আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
(ছ) যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং আল্লাহর দ্বীনকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, সেইসব কাফের অপশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করাই ছিল যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য। শেষনবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যেমন আল্লাহ বলেন, তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতিকে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ স্বীয় জ্যোতিকে (ইসলামকে) পূর্ণতা দান করবেন। যদিও অবিশ্বাসীরা তা পসন্দ করে না’। ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা পসন্দ করে না’ (ছফ ৬১/৮-৯; তওবাহ ১/৩২)।
(জ) কোন মুসলিম যদি কুফরী শক্তির দোসর হিসাবে কাজ করে, তাহ’লে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’। মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (সাঃ)তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।
(ঝ) মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ। কোন কারণে যুদ্ধ লাগলে অন্যদের দায়িত্ব হবে উভয় পক্ষকে থামানো এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়াা’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। নইলে বিরত থাকা। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, এই এক ঝাক আমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে এ বিষয়টি যে, আল্লাহ আমার উপর আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। লোকেরা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিত্না অবশিষ্ট থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)। জবাবে তিনি বলেন, আমরা যুদ্ধ করেছি যাতে ফিৎনা (শিরক ও কুফর) না থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তোমরা যুদ্ধ করছ যাতে ফিত্না (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয় এবং দ্বীন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (শত্রুর) জন্য হয়ে যায়’ (বুখারী হা/৪৫১৩)। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তুমি কি জানো ফিনা কি? মুহাম্মাদ (সাঃ)যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে। আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাই ছিল ফিৎনা। তোমাদের মত শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ নয়’ (বুখারী হা/৪৬৫১, ৭০৯৫)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, সত্বর তোমাদের মধ্যে ফিনাসমূহ সৃষ্টি হবে। তখন তোমাদের মধ্যেকার বসা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে এবং বসা ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। আর হাঁটা ব্যক্তি দৌড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। যদি কেউ আশ্রয়স্থল বা বাঁচার কোন স্থান পায়, তবে সে যেন সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়’। ফিৎনার সময় করণীয় প্রসঙ্গে হযরত সা’দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) রাসূল (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমাকে হত্যার জন্য আমার ঘরে ঢুকে কেউ আমার দিকে হাত বাড়াবে, তখন আমি কি করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, “তুমি আদমের পুত্রের মত হও’ (অর্থাৎ হাবীলের মত মৃত্যুকে বরণ কর)। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়েদাহ ২৮ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন’। যেখানে হত্যাকারী ক্বাবীলের বিরুদ্ধে হাবীলের উক্তি উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন, ‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য আমার হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৮)।  আবু মূসা আশআরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমাদের কারু গৃহে ফেনা প্রবেশ করবে, তখন সে যেন আদমের দুই পুত্রের উত্তমটির মত হয়
ক্বিবলা পরিবর্তন
নাখলা অভিযান শেষ হবার পর ২য় হিজরীর শাবান মাসে (ফেব্রুয়ারী ৬২৪ খৃ.) ক্বিবলা পরিবর্তনের আদেশ সূচক আয়াতটি (বাক্বারাহ ২/১৪৪) নাযিল হয়। যাতে ১৬/১৭ মাস পরে বায়তুল মুক্বাদ্দাস হাতে কাবার দিকে মুখ ফিরিয়ে ছালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।এই হুকুম নাযিলের মাধ্যমে কপট ইহুদীদের মুখোশ খুলে যায়। যারা মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়েছিল স্রেফ ফাটল ধরানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য। এখন তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেল এবং মুসলমানেরাও তাদের কপটতা ও খেয়ানত থেকে বেঁচে গেল। একই সময়ে রামাযানের ছিয়াম ও যাকাতুল ফিত্র ফরয করা হয়।
বদর যুদ্ধ
হিজরতের অনধিক ১৯ মাস পর ২য় হিজরীর ১৭ই রামাযান শুক্রবার সকালে (৬২৪ খৃ. ১১ই মার্চ) ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ সংঘটিত হয়।এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ৬ জন মুহাজির ও ৮ জন আনছারসহ মোট ১৪ জন শহীদ হন। কাফের পক্ষে ৭০ জন নিহত ও ৭০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বন্দী হয় (আর-রাহীক্ব ২২৪ পৃঃ)। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।
বদর হ’ল মদীনা থেকে ১৬০ কি. মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্রের নাম। যেখানে পানির প্রাচুর্য থাকায় স্থানটির গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। এখানেই সংঘটিত হয় ইসলামের ইতিহাসে তাওহীদ ও শিরকের মধ্যকার প্রথম সশস্ত্র মুকাবিলা। ১৯ মাসের এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে কুরায়েশরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে মদীনা থেকে বের করে দেবার জন্য নানাবিধ অপচেষ্টা চালায়। যেমনভাবে তারা ইতিপূর্বে হারশায় হিজরতকারী মুসলমানদের সেখান থেকে বের করে দেবার ষড়যন্ত্র করেছিল। কিন্তু সেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছিল প্রধানতঃ তিনটি কারণে। (১) সেখানে ছিল একজন ধর্মপরায়ণ খ্রিষ্টান বাদশাহ আছহামা নাজাশীর রাজত্ব। যিনি নিজে ইনজীলে পন্ডিত ছিলেন এবং সেকারণে আখেরী নবী হিসাবে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। (২) মক্কা ও হাবশার মধ্যখানে ছিল আরব সাগরের একটি প্রশস্ত শাখা। যা পেরিয়ে ওপারে গিয়ে হামলা করা সম্ভব ছিল না। (৩) হাবশার লোকেরা ছিল হিব্রুভাষী। তাদের সাথে কুরায়েশদের ভাষাগত মিল ছিল না এবং কোনরূপ আত্মীয়তা বা পূর্ব পরিচয় ছিল না। ধর্ম ও অঞ্চলগত মিলও ছিল না।
পক্ষান্তরে ইয়াছরিব ছিল কুরায়েশদের খুবই পরিচিত এলাকা। যার উপর দিয়ে তারা নিয়মিতভাবে সিরিয়াতে ব্যবসার জন্য যাতায়াত করত। তাছাড়া তাদের সঙ্গে ভাষাগত মিল এবং আত্মীয়তাও ছিল। অধিকন্তু রাস্তা ছিল স্থলপথ, যেখানে নদী-নালার কোন বাধা নেই। দূরত্ব বর্তমানের হিসাবে প্রায় ৪৬০ কিলোমিটার হ’লেও সেখানে যাতায়াতে তারা অভ্যস্ত ছিল। এক্ষণে আমরা বদর যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পরোক্ষ কারণগুলি সংক্ষেপে বর্ণনা করব।
বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা
বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সামান্য বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী কেউ গাছের নীচে কেউ ঢালের নীচে ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্তুত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে দৃঢ় হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এল। সেই সাথে অধিকহারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তিনি তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং তোমাদের উপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য, তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখার জন্য’ (আনফাল ৮/১১)।
শয়তানের কুমন্ত্রণা এই যে, সে যেন দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেবার সুযোগ না পায় যে, আমরা যদি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব এবং আমরা যদি আল্লাহর বন্ধু হই, তাহ’লে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-কাদার মধ্যে কেন থাকব? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের পরাজয়ের লক্ষণ। অথচ কুরায়েশরা কাফের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফূর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সকালেই যেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হ’তে হবে, সেখানে রাতেই যদি সংখ্যালঘু মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঢুকে যায়, তাহ’লে সেটা সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। সেকারণ আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেল।
আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, যিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতীত। তিনি সারা রাত জেগে ছালাতে রত থাকেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)বারবার স্বীয় প্রভুর নিকট দো’আ করতে থাকেন হে আল্লাহ! যদি তুমি এই দলকে ধ্বংস করে দাও, তাহ’লে জনপদে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’। অতঃপর সকাল হলে তিনি সবাইকে ডাকেন, আল্লাহর বান্দারা! ছালাত’। অতঃপর সবাই জমা হ’লে তিনি ফজরের জামা’আত শেষে সবাইকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন’।
আলী (রাঃ) বলেন, বদরের যুদ্ধের দিন আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের মধ্যে শত্রুর সর্বাধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং আমাদের সকলের চাইতে সর্বাধিক বড় যোদ্ধা ছিলেন’ (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ ছহীহ)।
গণীমত বণ্টন
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। উবাদাহ বিন ছামেত (রাঃ) বলেন যে, এরি মধ্যে গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা তার সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গণীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূল (ছাঃ)-কে পাহারা দিয়ে তাঁকে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল। এ সময় সূরা আনফাল ১ম আয়াত নাযিল হয়। লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে। বলে দাও, গণীমতের মাল সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। অতঃপর সেমতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন।
মদীনায় অভ্যর্থনা
বিজয়ী কাফেলা রাওহা ) ( পৌঁছলে মদীনা থেকে আগমনকারী অগ্রবর্তী অভ্যর্থনাকারী দলের সাথে প্রথম মুলাকাত হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৪৩)। তারা বিপুল উৎসাহে বিজয়ী রাসূলকে অভ্যর্থনা জানায়। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে রাসূল (সাঃ)-এর সাথী ছাহাবী সালামা বিন সালামাহ বলেন ‘তোমরা কিজন্য আমাদের মুবারকবাদ দিচ্ছ? ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো কিছু টেকো মাথা বুড়োদের মুকাবিলা করেছি মাত্র, যারা ছিল বাঁধা উটের মত, যাদেরকে আমরা যবহ করেছি’। তার কথা বলার ঢং দেখে রাসূল (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন ‘হে ভাতিজা! ওরাই তো বড় বড় নেতা’।এ সময় ছাহাবী উসায়েদ বিন হু্যায়ের আনছারী যিনি বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, তিনি সাক্ষাৎ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে বিজয় দান করেছেন ও আপনার চক্ষুকে শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা ভেবে বদরে গমন হ’তে পিছনে থাকিনি যে, আপনার মুকাবিলা শত্রুদের সাথে হবেi আমি তো ভেবেছিলাম এটা স্রেফ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর বিষয়। যদি বুঝতাম যে, এটা শত্রুদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা, তাহ’লে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না’। রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি সত্য বলেছ’ (আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫)। পরের বছর ওহোদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে আনছার বাহিনীর মধ্যে আউসদের পতাকাবাহী নিযুক্ত করেন। অতঃপর একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ এরি মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন।
ওহোদ যুদ্ধ (৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল)
কুরায়েশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহোদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি মহিলা দল ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে। এই যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যয়ে পরিণত হয়। মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। তার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, আনছার ৬৫ জন। যাদের মধ্যে আউস ২৪, খাযরাজ ৪১ এবং ইহুদী ১ জন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। তবে এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। বরং কুরায়েশ পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী (‘জয়-পরাজয় পর্যালোচনা’ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।
এই যুদ্ধে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হ’লেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।
যুদ্ধের কারণ
মক্কা থেকে শামে কুরায়েশদের ব্যবসায়ের পথ নিরংকুশ ও নিরাপদ করাই ছিল তাদের এই যুদ্ধের মূল কারণ।
অতঃপর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল, বদর যুদ্ধে কুরায়েশদের শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের পালিয়ে আসার গ্লানিকর অভিজ্ঞতা এবং সবশেষে ছাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার সোজা পথ ছেড়ে নাজদের ঘোরা পথ ধরে সিরিয়া গমনকারী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা ছাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাকর ঘটনা। যার প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধের পুঁজি
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহোদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৬০)।
মাক্কীদের যুদ্ধ প্রস্তুতি
মুসলিম শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তারা সাধারণ বিজ্ঞপ্তি জারী করে দিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক বেদুঈন, কেনানা ও তেহামার অধিবাসীদের মধ্যকার যেকোন ব্যক্তি যেন এই যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীতে শরীক হয়। লোকদের উত্তেজিত ও উৎসাহিত করার জন্য দু’জন কবি আবু ‘আযযাহ) এবং মুসাফে’ বিন ‘আব্দে মানাফ আল-জুমাহী কে কাজে লাগানো হয়। প্রথমজন বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। পরে রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা করবে না, এই শর্তে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই সে মুক্তি পায়। তাকে গোত্রনেতা ছাফওয়ান বিন উমাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসলে তাকে ধনশালী করে দিবেন। আর নিহত হ’লে তার কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন’। ফলে উক্ত দুই কবি অর্থ-সম্পদের লোভে সর্বত্র যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হ’ল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু অলীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হ’লেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।
মদীনায় সংবাদ প্রাপ্তি
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুতির খবর রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন কোবায় অবস্থান করছিলেন। উবাই ইবনু কা’ব (রাঃ) পত্রটি রাসূল (সাঃ)-কে পাঠ করে শুনান। তিনি উবাইকে পত্র প্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও দ্রুত মদীনায় এসে মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে বসেন। অন্যদিকে মদীনার চারপাশে পাহারা দাঁড় করানো হ’ল। স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর দ্বাররক্ষী হিসাবে রাত্রি জেগে পাহারা দেবার জন্য আউস নেতা সা’দ বিন মু’আয, খাযরাজ নেতা সাদ বিন ওবাদাহ এবং উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ আনছার নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে নিয়োজিত করলেন। চারদিকে গোয়েন্দা প্রেরণ করা হ’ল মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দাগণ নিয়মিতভাবে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তাদের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন।
গাযওয়া নাজদ
৪র্থ হিজরীর রবীউল আখের মাস। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সংবাদ পেলেন যে, বনু গাত্বফানের দু’টি গোত্র বনু মুহারিব ও বনু ছা’লাবাহ মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বেদুঈন ও পল্লীবাসীদের মধ্য হ’তে সৈন্য সংগ্রহ করছে। এ খবর পাওয়ার সাথে সাথে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) নাজদ অভিমুখে যাত্রা করেন। এই আকস্মিক অভিযানে উদ্ধৃত বেদুঈনরা ভয়ে পালিয়ে যায় ও তাদের মদীনা আক্রমণের স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে যায়। এই সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন ওছমান বিন ‘আফফান (রাঃ)’ (আর-রাহীক্ব ২৯৭-৯৮ পৃঃ)।
 গাযওয়া বদর আখের
৪র্থ হিজরীর শাবান মোতাবেক ৬২৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাস। দেড় হাযার সৈন্য নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদর অভিমুখে রওয়ানা হন। গত বছর ওহোদ যুদ্ধ থেকে ফিরে যাওয়ার সময় আবু সুফিয়ান আগামী বছর পুনরায় মদীনা আক্রমণ করবেন বলে ওয়াদা করেছিলেন। তার হামলা মুকাবিলার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আগে ভাগেই বদর প্রান্তরে উপস্থিত হন। ওদিকে আবু সুফিয়ান ২০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে যথাসময়ে রওয়ানা হয়ে মার যাহরান পৌঁছে ‘মাজিন্নাহ’ ঝর্ণার নিকটে শিবির স্থাপন করেন। কিন্তু তিনি যুদ্ধ করার মনোবল হারিয়ে ফেলেন এবং বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে মক্কায় ফিরে যেতে চান। তাতে সৈন্যদের সকলে এক বাক্যে সায় দেয় এবং সেখান থেকেই তারা মক্কায় ফিরে যায়।
৮ দিন অপেক্ষার পর শত্রুপক্ষের দেখা না পেয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। এরি মধ্যে মুসলমানেরা সেখানে ব্যবসা করে দ্বিগুণ লাভবান হন। উল্লেখ্য যে, বদর ছিল অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাণিজ্য কেন্দ্র। সংঘর্ষ না হ’লেও এই অভিযানকে বদরে আখের বা বদরের শেষ যুদ্ধ বলা হয়। আবু সুফিয়ানের পশ্চাদপসারণের ঘটনায় সারা আরবে মুসলিম শক্তির প্রতি সকলের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হয়। সাথে সাথে মুসলমানদের মনোবল দারুণভাবে বৃদ্ধি পায়। এই যুদ্ধে যাওয়ার সময় মদীনার দায়িত্বে থাকেন আব্দুল্লাহ ইবনে রওয়াহা (রাঃ) এবং যুদ্ধের পতাকাবাহী ছিলেন হযরত আলী (রাঃ)।
গাযওয়া দূমাতুল জান্দাল
৫ম হিজরীর ২৫শে রবীউল আউয়াল। খবর এলো যে, সিরিয়ার নিকটবর্তী দুমাতুল জান্দাল শহরের একদল লোক সিরিয়া যাতায়াতকারী ব্যবসায়ী কাফেলা সমূহের উপরে ডাকাতি ও লুটপাট করে। তারা মদীনায় হামলার জন্য বিরাট এক বাহিনী প্রস্তুত করছে। রাসূল (ছাঃ) কালবিলম্ব না করে ১০০০ ফৌজ নিয়ে মদীনা হ’তে ১৫ রাত্রির পথ অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু সেখানে পৌঁছে কাউকে পেলেন না। শত্রুপক্ষ টের পেয়ে আগেই পালিয়ে গিয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে কয়েকদিন অবস্থান করেন ও চারদিকে ছোট ছোট সেনাদল প্রেরণ করেন। কিন্তু শত্রুদের কারু নাগাল পাওয়া যায়নি। অবশেষে কিছু গবাদিপশু নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। এতে লাভ হয় এই যে, শত্রুরা আর মাথা চাড়া দেয়নি। তাতে ইসলাম প্রচারের শান্ত পরিবেশ তৈরী হয়। পথিমধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু ফাযারাহ গোত্রের নেতা ওয়ায়না বিন হিছন-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করেন। এ যুদ্ধের সময় মদীনার আমীর ছিলেন সিবা’ বিন ‘উরফুতাহ আল-গিফারী।
হোদায়বিয়ার সন্ধি (৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা’দাহ মাস)
হোদায়বিয়ার সন্ধিকে “গাযওয়া’ বা যুদ্ধ বলা হয় এ কারণে যে, কুরায়েশরা রাসূল (সাঃ)-কে এখানে ওমরার জন্য মক্কায় প্রবেশে বাধা দিয়েছিল’ (সীরাহ ছহীহাহ ২/৪৩৪)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ১লা ফুলকা দাহ সোমবার স্ত্রী উম্মে সালামাহ সহ ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে ওমরাহর উদ্দেশ্যে মদীনা হ’তে মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় কোষবদ্ধ তরবারি ব্যতীত তাদের সাথে অন্য কোন অস্ত্র ছিল না। কিন্তু মক্কার অদূরে হোদায়বিয়া নামক স্থানে পৌঁছলে তাঁরা কুরায়েশ নেতাদের বাধার সম্মুখীন হন। অবশেষে তাদের সঙ্গে দশ বছরের জন্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে চুক্তির শর্তানুযায়ী তিনি মদীনায় ফিরে আসেন এবং পরের বছর ওমরা করেন। বিস্তারিত নিম্নরূপ।
‘হোদায়বিয়া’ ) ( একটি কূয়ার নাম। যা মক্কা থেকে উত্তর-পশ্চিমে ২২ কি.মি. দূরে অবস্থিত। এটি বর্তমানে ‘শুমাইসী’ নামে পরিচিত। এখানে হোদায়বিয়ার বাগিচাসমূহ এবং রিযওয়ান মসজিদ অবস্থিত।
খন্দকের যুদ্ধে ভূমিধস বিজয়ের পরেও কুরায়েশদের শত্রুতা থেকে রাসূল (সাঃ) নিশ্চিন্ত ছিলেন না। সেকারণ অধিক সংখ্যক ছাহাবী নিয়ে তিনি ওমরায় এসেছিলেন এবং সাথে অস্ত্রও ছিল। ফলে যুদ্ধ হবে মনে করে দুর্বলচেতা ও বেদুঈন মুসলমানরা বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে সরে পড়ে। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন,পিছনে পড়ে থাকা বেদুঈনরা সত্বর তোমাকে বলবে, আমাদের মাল-সম্পদ ও পরিবার আমাদেরকে ব্যস্ত রেখেছিল। অতএব আপনি আমাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন। তারা মুখে একথা বলবে, যা তাদের অন্তরে নেই। বল, আল্লাহ তোমাদের কোন ক্ষতি বা উপকার করতে চাইলে কে তাকে বিরত রাখতে পারে? বরং তোমরা যা কিছু কর সবই আল্লাহ খবর রাখেন’। ‘বরং তোমরা ধারণা করেছিলে যে, রাসূল ও মুমিনগণ তাদের পরিবারের কাছে আর কখনই ফিরে আসতে পারবে না এবং এই ধারণা তোমাদের অন্তরগুলিকে সুশোভিত করে রেখেছিল। আর তোমরা মন্দ ধারণা করেছিলে। বস্তুতঃ তোমরা ছিলে ধ্বংসমুখী এক সম্প্রদায়’ (ফাহ ৪৮/১১-১২)। এখানে বেদুঈন বলতে মদীনার জুহাইনা ও মুযাইনা গোত্র দ্বয়কে বুঝানো হয়েছে  (তাফসীর তাবারী)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে এক রাতে স্বপ্ন দেখানো হ’ল যে, তিনি স্বীয় ছাহাবীদের সাথে নিয়ে মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করছেন এবং ওমরাহ করছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, আল্লাহ্‌ তাঁর রাসুল কে সত্য স্বপ্ন দেখিয়েছেন। আল্লাহ চাহেন তো তোমরা অবশ্যই মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে নিরাপদে মস্তক মুন্ডিত অবস্থায় এবং কেশ কর্তিত অবস্থায়। এমনভাবে যে, তোমরা কাউকে ভয় করবে না। অতঃপর তিনি জানেন, যা তোমরা জানো না। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে একটি নিকটবর্তী বিজয় দান করবেন। (ফাহ ৪৮/২৭)। অর্থাৎ তোমাদেরকে মক্কায় প্রবেশ না করিয়ে হোদায়বিয়া থেকে ফেরৎ আনার মধ্যে তোমাদের জন্য কি কল্যাণ নিহিত থাকবে, তা তোমরা জানো না। অতঃপর সেই প্রত্যাবর্তনের বিনিময়ে তোমাদেরকে তিনি দান করবেন একটি ‘নিকটবর্তী বিজয়’। অর্থাৎ হোদায়বিয়ার সন্ধি। অতঃপর সেখান থেকে ফিরেই হবে খায়বর বিজয় ও বিপুল গণীমত লাভ।
এ স্বপ্ন দেখার পরে তিনি ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ছাহাবীদের প্রস্তুত হাতে বলেন। ইতিপূর্বে খন্দক যুদ্ধে বিজয় লাভের পর সমগ্র আরবে মুসলিম শক্তিকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসাবে গণ্য করা হ’তে থাকে। তাই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কিছুটা স্বস্তির মধ্যে ছিলেন।
ওমরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা
৬ষ্ঠ হিজরীর ১লা যুলকাদাহ সোমবার তিনি ১৪০০ (মতান্তরে ১৫০০) সাথী নিয়ে মদীনা হাতে রওয়ানা হন (বুখারী হা/৪১৫৩)। লটারিতে এবার তাঁর সফরসঙ্গী হন উম্মুল মুমেনীন হযরত উম্মে সালামাহ (রাঃ)। ওমরাহর সফরে নিয়মানুযায়ী কোষবদ্ধ তরবারি এবং মুসাফিরের হালকা অস্ত্র ব্যতীত অন্য কোন অস্ত্র তাঁদের নিকটে রইল না। অতঃপর মদীনা থেকে অনতিদূরে যুল-হুলায়ফা পৌঁছে তাঁরা ওমরাহর ইহরাম বাঁধেন। অতঃপর ৭০টি উটের গলায় হার পরালেন এবং উটের পিঠের কুঁজের উপরে সামান্য কেটে রক্তপাত করে কুরবানীর জন্য চিহ্নিত করলেন। আবু কাতাদাহ আনছারী (রাঃ)-সহ অনেক ছাহাবী মুহরিম ছিলেন না। মুসলমানদের মিত্র বনু খোয়া’আ গোত্রের বিশর বিন সুফিয়ান আল-কা‘বী(সা) কে গোয়েন্দা হিসাবে রাসূল (সাঃ) আগেই মক্কায় পাঠিয়েছিলেন কুরায়েশদের গতিবিধি জানার জন্য। অতঃপর রাসূল (সাঃ) মক্কা থেকে ৮০ কি. মি. দূরে ‘ওসফান’ পৌঁছলে উক্ত গোয়েন্দা এসে রাসূল (সাঃ)-কে খবর দেন যে, কুরায়েশরা ওমরাহতে বাধা দেওয়ার জন্য যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে। এজন্য তারা তাদের মিত্র বেদুঈন গোত্র সমূহকে সংঘবদ্ধ করেছে। তারা আপনার সফরের কথা শুনেছে এবং যুদ্ধ সাজে সজ্জিত অবস্থায় যু-তুওয়া(Si)তে পৌঁছে গেছে। তারা আল্লাহর নামে কসম করেছে যে, আপনি কখনোই মক্কায় প্রবেশ করতে পারবেন না। অন্যদিকে খালেদ বিন অলীদ তার অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে মক্কা থেকে ৬৪ কি. মি. দূরে কুরাউল গামীমে পৌঁছে গেছে। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,
“হায় দুর্ভোগ কুরায়েশদের জন্য! যুদ্ধ তাদের খেয়ে ফেলেছে। যদি তারা আমার ও অন্যদের মধ্য থেকে সরে দাঁড়াত, তাহালে তাদের কি সমস্যা ছিল? যদি তারা আমার ক্ষতি সাধন করতে পারে, তবে সেটি তাদের আশানুরূপ হবে। আর যদি আল্লাহ আমাকে তাদের উপর বিজয়ী করেন, তাহ’লে তারা ইসলামে প্রবেশ করবে পুরোপুরি লাভবান অবস্থায়। আর যদি ইসলাম কবুল না করে, তাহ’লে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে যতক্ষণ তাদের শক্তি থাকবে। সুতরাং কুরায়েশরা কী ধারণা করে? আল্লাহর কসম! আমি তাদের বিরুদ্ধে সেই দ্বীনের উপর যুদ্ধ চালিয়ে যাব, যার জন্য আল্লাহ আমাকে পাঠিয়েছেন। যতক্ষণ না আল্লাহ তাকে বিজয়ী করেন অথবা এই ক্ষুদ্র দল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়’।রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত বক্তব্যে তাঁর শান্তিবাদী নীতি ফুটে উঠে।
খায়বর যুদ্ধ (৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহুদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ ছাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি কোন মুনাফিককে এ যুদ্ধে নেননি। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১৬ জন শহীদ এবং ইহুদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহুদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয় (বুখারী হা/৪২৩৫)।
যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফাদাকের ইহুদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুহাইয়েছাহ বিন মাসউদকে  প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পর তারা নিজেরা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূল (সাঃ) -এর দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফাদাক ভূমি কেবল রাসূল (সাঃ) -এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।
যিলহাজ্জের মাঝামাঝিতে হোদায়বিয়া থেকে ফিরে মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তিনি সেবা বিন উরফুত্বাহ গেফারীকে মদীনার প্রশাসক নিয়োগ করে যান।
মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহুদী- এগুলির মধ্যে প্রধান শক্তি কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বাকী রইল ইহুদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এদেরকে দমন করার জন্য এই অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে যাতে কোন মুনাফিক যেতে না পারে, সেজন্য আল্লাহ পূর্বেই আয়াত নাযিল করেন (ফাহ ৪৮/১৫)। তাছাড়া এ যুদ্ধে যে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হবে এবং প্রচুর গণীমত লাভ করবে, সে বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী নাযিল হয়েছিল (ফাহ ৪৮/২০)। ফলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কেবলমাত্র ঐ সকল সাথীকে সঙ্গে নিলেন, যারা হোদায়বিয়ার সফরে বায় আতুর রিযওয়ানো শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০। এঁদের সাথে কিছু সংখ্যক মহিলা ছাহাবী ছিলেন। যারা আহতদের সেবা-যত্নে নিযুক্ত হন। আল্লাহপাকের এই আগাম হুঁশিয়ারীর কারণ ছিল এই যে, মুনাফিকদের সঙ্গে ইহুদীদের সখ্যতা ছিল বহু পুরাতন। তাই তারা যুদ্ধে গেলে তারা বরং ইহুদীদের স্বার্থেই কাজ করবে, যা মুসলিম বাহিনীর চরম ক্ষতির কারণ হবে।
মুনাফিকদের অপতৎপরতা
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খায়বর অভিযানের গোপন খবর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই আগেভাগেই ইহুদীদের জানিয়ে দিয়ে তাদের কাছে পত্র পাঠায়। তাতে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা হয় এবং একথাও বলা হয় যে, ‘তোমরা অবশ্যই জিতবে। কেননা মুহাম্মাদের লোকসংখ্যা অতীব নগণ্য এবং তারা প্রায় রিক্তহস্ত’। খয়বরের ইহুদীরা এই খবর পেয়ে তাদের মিত্র বনু গাত্বফানের নিকটে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠায়। তাদেরকে বলা হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলে খায়বরের মোট উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে’। উক্ত লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে বনু গাত্বফানের লোকেরা পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে খায়বর অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিছু দূর গিয়েই তারা পিছন দিকে শোরগোল শুনে ভাবল, হয়তবা মুসলিম বাহিনী তাদের সন্তানাদি ও পশুপালের উপরে হামলা চালিয়েছে। ফলে তারা খায়বরের চিন্তা বাদ দিয়ে স্ব স্ব গৃহ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করল। বলা বাহুল্য, এটা ছিল আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, মুসলমানদের ব্যাপারে তারা দারুণ ভীত ছিল। কেননা ইতিপূর্বে তারা খন্দকের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। এরপর সম্প্রতি কুরায়েশরা মুসলমানদের সঙ্গে হোদায়বিয়ায় সন্ধিচুক্তি করেছে। তাতে মুসলিম ভীতি সর্বত্র আরও ব্যাপকতা লাভ করে।
রাসূল (সাঃ)-কে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা
খায়বর বিজয়ের পর রাসূল (সাঃ) যখন একটু নিশ্চিন্ত হ’লেন, তখন বিতাড়িত বনু নাযীর গোত্রের অন্যতম নেতা ও কোষাধ্যক্ষ সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাকে বকরীর ভূনা রান হাদিয়া পাঠায়। সে আগেই জেনে নিয়েছিল যে, রাসূল (সাঃ) রানের গোশত পসন্দ করেন। এজন্য উক্ত মহিলা উক্ত রানে ভালভাবে বিষ মাখিয়ে দিয়েছিল। রাসূল (সাঃ) গোশতের কিছু অংশ চিবিয়ে ফেলে দেন, গিলেননি। অতঃপর বলেন, এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে, সে বিষ মিশ্রিত’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন উক্ত মহিলাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে সে কৈফিয়ত দিয়ে বলল, এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল এই যে, যদি এই ব্যক্তি বাদশাহ হন, তাহ’লে আমরা তার থেকে নিষ্কৃতি পাব। আর যদি নবী হন, তাহ’লে তাঁকে বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হবে। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমরা চেয়েছিলাম যদি আপনি মিথ্যাবাদী হন, তাহ’লে আমরা নিষ্কৃতি পাব। আর যদি আপনি নবী হন, তাহ’লে এ বিষ আপনার কোন ক্ষতি করবে না’।তখন রাসূল (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু সাথী বিশর বিন বারা বিন মাস্কর এক টুকরা চিবিয়ে খেয়ে ফেলেছিলেন। যাতে তিনি মারা যান। ফলে তার বদলা স্বরূপ ঐ মহিলাকে হত্যা করা হয়।
গণীমত বণ্টন
খায়বরের যুদ্ধে ভূমি সহ বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যার অর্ধেক ভবিষ্যৎ প্রয়োজনের জন্য রেখে দিয়ে বাকী অর্ধেক ১৮০০ ভাগে ভাগ করা হয়। হোদায়বিয়ার ১৪০০ সাথীর মধ্যে উপস্থিত ও অনুপস্থিত সকলের জন্য অংশ নির্ধারিত ছিল। এদের মধ্যে ২০০ জন ছিলেন অশ্বারোহী। প্রত্যেক পদাতিকের জন্য একভাগ ও অশ্বারোহীর জন্য ঘোড়ার দু’ভাগ সহ তিন ভাগ। এক্ষণে ১২০০ পদাতিকের জন্য ১২০০ ভাগ এবং ২০০ অশ্বারোহীর জন্য ৬০০ ভাগ, সর্বমোট ১৮০০ ভাগে গণীমত বণ্টন করা হয়। উক্ত হিসাবে আল্লাহর রাসূলও একটি ভাগ পান। মহিলাদের জন্য গণীমতের অংশ দেওয়া হয়নি। তবে ‘ফাই’ থেকে তাদের দেওয়া হয় (তারীখ তাবারী ৩/১৭)।
সাাদের পতাকা তার পুত্রের নিকট হস্তান্তর
এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যায়। আনছারদের পতাকা ছিল খাযরাজ নেতা সাদ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর হাতে। তিনি ইতিপূর্বে ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলেন, আজ হ’ল মারপিটের দিন। আজ কা’বাকে হালাল করা হবে’। অতঃপর রাসূল (সাঃ)  ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শুনেছেন সাদ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন কি বলেছে? তখন তাকে উক্ত কথা বলা হ’ল। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, সাদ মিথ্যা বলেছে। বরং আজ হ’ল সেই দিন যেদিন আল্লাহ তা’আলা কা’বাকে সম্মানিত করবেন’ (বুখারী হা/৪২৮০)। তখন হযরত ওছমান ও আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ রাসূল (সাঃ) কে বললেন, আমরা সা’দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই। হয়ত সে কুরায়েশদের মারপিট শুরু করে দেবো। একথা শুনে তিনি একজনকে পাঠিয়ে সা’দের নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তার পুত্র কায়েসকে দিলেন। যাতে সে বুঝতে পারে যে, পতাকা তার হাত থেকে বাইরে যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, পতাকাটি যুবায়ের (রাঃ)-কে প্রদান করা হয় (যাদুল মা’আদ ৩/৩৫৬)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অতিক্রম করে যাওয়ার পর হযরত আববাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে বললেন, ‘তোমার কওমের দিকে দৌড়াও’। আবু সুফিয়ান অতি দ্রুত মক্কায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন,হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ এসে গেছেন, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। অতএব যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’। এ ঘোষণা শুনে তার স্ত্রী হিন্দা এসে তার মোচ ধরে বলে ওঠেন, এই চর্বিওয়ালা শক্ত মাংসধারী মশকটাকে তোমরা মেরে ফেল। এরূপ দুঃসংবাদ দানকারীর মন্দ হৌক’! আবু সুফিয়ান বললেন, তোমরা সাবধান হও! এই মহিলা যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে। লোকেরা বলল, হে আবু সুফিয়ান! আপনার গৃহে কয়জনের স্থান হবে? তিনি বললেন, ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ থাকবে’ (ছহীহাহ হা/৩৩৪১)। একথা শোনার পর লোকেরা স্ব স্ব গৃহ এবং বায়তুল্লাহর দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল। কিন্তু কিছু সংখ্যক নির্বোধ লোক ইকরিমা বিন আবু জাহল, ছাফওয়ান বিন উমাইয়া, সোহায়েল বিন আমর প্রমুখের নেতৃত্বে মক্কার ‘খান্দামা) ( পাহাড়ের কাছে গিয়ে জমা হ’ল মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে কুরায়েশ মিত্র বনু বকরের জনৈক বীর হিমাস বিন ক্বায়েস  ছিল। যে ব্যক্তি মুসলমানদের মুকাবিলার জন্য ধারালো অস্ত্র শান দিয়েছিল এবং মুসলমানদের ধরে এনে তার স্ত্রীর গোলাম বানাবার অহংকার প্রদর্শন করে স্ত্রীর সামনে কবিতা পাঠ করেছিল’।
রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার চেষ্টা
শায়বা বিন ওছমান বিন আবু ত্বালহা আল-‘আবদারী আল-হাজাবী, যিনি মক্কা বিজয়ের দিন মুসলমান হন এবং হোনায়েন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের প্রথম দিকে বিপর্যয়কর অবস্থায় যখন রাসূল (সাঃ) খচ্চর থেকে নেমে পড়েন, তখন তাঁকে সুযোগ পেয়ে হত্যা করার অপচেষ্টা চালান। কারণ তার পিতা ওছমান বিন আবু ত্বালহা ওহোদ যুদ্ধের দিন আলী (রাঃ)-এর হাতে নিহত হন। তিনি বলেন, তখনই আমি প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করি যে, আরব-আজমের সবাই যদি মুহাম্মাদের অনুসারী হয়, আমি কখনই তাঁর অনুসারী হবো না। ফলে যখন আমি মক্কা থেকে যুদ্ধে বের হই, তখন থেকেই আমি সুযোগের সন্ধানে থাকি। অতঃপর আমি সুযোগ পেয়ে তাঁর নিকটবর্তী হই এবং হত্যার জন্য তরবারী উঠাই। হঠাৎ আমার সামনে বিদ্যুতের চমকের ন্যায় একটা আগুনের ফুলকি জ্বলে ওঠে। যা আমাকে জ্বালিয়ে দেওয়ার উপক্রম করে। আমি ভয়ে চোখে হাত দেই। তখন রাসূল (সাঃ) আমার দিকে তাকান ও আমাকে ডেকে বলেন, হে শায়বা আমার নিকটে এসো! আমি তাঁর নিকটে গেলাম। অতঃপর তিনি আমার বুকে হাত রেখে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি একে শয়তান থেকে পানাহ দাও’। এতে আমার ভিতরের সব উত্তেজনা দূর হয়ে গেল। আল্লাহর কসম! তখন তিনি আমার নিকটে আমার জীবনের চাইতে প্রিয় হয়ে যান’। আমৃত্যু তাঁর ইসলাম সুন্দর ছিল। ৫৮ বা ৫৯ হিজরীতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, মক্কা বিজয়ের দিন তার চাচাতো ভাই ওছমান বিন ত্বালহাকে রাসূল(সাঃ) কাবাগৃহের চাবি হস্তান্তর করেন’ (আল-ইছাবাহ, ওছমান বিন তালহা ক্রমিক ৫৪৪৪)।
রাসূল (ছাঃ)-এর তেজস্বিতা
হোনায়েন-এর সংকটকালে যখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পাশে মুষ্টিমেয় কয়েকজন ব্যতীত কেউ ছিলনা, তখন তাঁর বীরত্ব ও তেজস্বিতা ছিল অতুলনীয়। তিনি স্বীয় সাদা খচ্চরকে কাফের বাহিনীর দিকে এগিয়ে যাবার জন্য উত্তেজিত করতে থাকেন ও বলতে থাকেন, “আমি নবী। মিথ্যা নই’। ‘আমি আব্দুল মুত্ত্বালিবের পুত্র’।অর্থাৎ আমি যে সত্য নবী তার প্রমাণ যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের উপরে নির্ভর করে না। এ সময় রাসূল (সাঃ) ডানদিকে ফিরে ডাক দিয়ে বলেন, আমার দিকে এসো হে লোকেরা! আমি আল্লাহর রাসূল’। ‘আমি আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ’।
এসময় রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে ১০ থেকে ১২ জন ছাহাবী ব্যতীত কেউ ছিল না। তন্মধ্যে ছিলেন চাচা আববাস ও তার পুত্র ফযল বিন আববাস, চাচাতো ভাই নওমুসলিম আবু সুফিয়ান বিন হারেছ বিন আব্দুল মুতালিব ও তার পুত্র জাফর, আবুবকর, ওমর, আলী ও রাবী’আহ বিন হারেছ। তাছাড়া ছিলেন উসামাহ বিন যায়েদ এবং আয়মান বিন ওবায়েদ ওরফে আয়মান বিন উম্মে আয়মান। যিনি ঐ দিন শহীদ হয়েছিলেন (যাদুল মা’আদ ৩/৪১১)। আবু সুফিয়ান বিন হারেছ রাসূল ((সাঃ)-এর খচ্চরের লাগাম এবং চাচা আববাস বিন আব্দুল মুতালিব খচ্চরের রেকাব টেনে ধরে রেখেছিলেন, যাতে সে রাসূলকে নিয়ে সামনে বেড়ে যেতে না পারে। অতঃপর চাচা আববাসকে নির্দেশ দিলেন ছাহাবীগণকে উচ্চৈঃস্বরে আহবান করার জন্য। কেননা আববাস ছিলেন অত্যন্ত দরাজ কণ্ঠের মানুষ। তিনি সর্বশক্তি দিয়ে ডাক দিলেন, ‘বায়আতে রিযওয়ানের সাথীরা কোথায়? হে আনছারগণ!’ হে হারেছ বিন খাযরাজের বংশধরগণ!’ আব্বাস-এর উচ্চকণ্ঠের এই আওয়ায পাওয়ার সাথে সাথে গাভীর ডাকে দুধের বাছুর ছুটে আসার ন্যায় লাব্বায়েক লাববায়েক ধ্বনি দিতে দিতে চারদিক থেকে ছাহাবীগণ ছুটে এলেন।কারু কারু এমন অবস্থা হয়েছিল যে, স্বীয় উটকে ফিরাতে না পেরে স্রেফ ঢাল-তলোয়ার নিয়ে লাফিয়ে পড়ে ছুটে রাসূল (সাঃ) এর নিকটে চলে আসেন (ইবনু হিশাম ২/৪৪৪-৪৫)। এসময় রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘এখন যুদ্ধ জ্বলে উঠল ।
ফলে মুহূর্তের মধ্যে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এক মুষ্টি বালু উঠিয়ে কাফেরদের দিকে নিক্ষেপ করে বলেন, ‘চেহারাগুলো বিকৃত হৌকা।  এই এক মুঠো বালু শত্রুপক্ষের প্রত্যেকের দু’চোখে ভরে যায় এবং তারা পালাতে থাকে। ফলে যুদ্ধের গতি স্তিমিত হয়ে যায়। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, মুহাম্মাদের প্রতিপালকের কসম! ওরা পরাজিত হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটা ছিল আল্লাহর গায়েবী মদদ, যা তিনি ফেরেশতাগণের মাধ্যমে সম্পন্ন করেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, অতঃপর আল্লাহ তাঁর রাসূল ও বিশ্বাসীগণের প্রতি তাঁর বিশেষ প্রশান্তি নাযিল করলেন এবং এমন সেনাবাহিনী নাযিল করলেন, যাদেরকে তোমরা দেখোনি আর অবিশ্বাসীদের শাস্তি দিলেন। আর এটাই হল অবিশ্বাসীদের কর্মফল’ (তওবা ৯/26)
নারী-শিশু, পলাতক ও নিরস্ত্রদের হত্যার উপর নিষেধাজ্ঞা
যুদ্ধাবস্থায় একটি নারীর লাশ দেখতে পেয়ে রাসূল (সাঃ) ধিক্কার দিয়ে বলেন, নিশ্চয় এ নারী যুদ্ধের জন্য নয়’। এ সময় তিনি খালেদ বিন অলীদকে খবর পাঠান, কোন নারী এবং কোন নিরস্ত্র ব্যক্তিকে যেন কেউ হত্যা না করে’।এমনিভাবে তিনি শিশুদেরকে হত্যা করতে নিষেধ করেন। যখন তিনি শুনলেন যে, মুশরিকদের সন্তান মনে করে কেউ কেউ তাদের হত্যা করেছে। তিনি বললেন, ‘তোমাদের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগণ কি মুশরিকদের সন্তান নন? যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, প্রত্যেক সন্তানই ফিত্রাতের উপর জন্ম গ্রহণ করে, যতক্ষণ না সে কথা বলতে শেখে’ (আহমাদ হা/১৫৬২৬, ১৬৩৪২)। এতদ্ব্যতীত যারা পালিয়ে গিয়েছিল, তাদের কাউকে রাসূল (সাঃ) ধমকাননি। বরং যখন আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম তাঁকে বললেন, মক্কার নও মুসলিম পলাতকদের হত্যা করার জন্য। কারণ তাদের কারণেই পরাজয় হচ্ছিল। তখন জবাবে তিনি বলেন, ‘হে উম্মে সুলায়েম! নিশ্চয়ই আল্লাহ যথার্থ করেছেন ও সুন্দর ফায়ছালা করেছেন’। এ সময় উম্মে সুলায়েম আত্মরক্ষার জন্য দু’ধারি লম্বা অস্ত্র
‘খঞ্জরা বহন করছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেন? জবাবে তিনি বললেন, কোন মুশরিক কাছে এলে আমি এটা দিয়ে তার পেট ফেঁড়ে ফেলব। তার কথা শুনে রাসূল (সাঃ)হাসতে থাকেন’ (মুসলিম হা/১৮০৯ (১৩৪)।
প্রথমোক্ত দলের পশ্চাদ্ধাবনের জন্য ১০০০ সৈন্যসহ খালেদ বিন অলীদকে তায়েফে পাঠানো হয়। দ্বিতীয় দলটির জন্য আবু আমের আল-আশ’আরীকে একটি সেনাদল সহ আওত্বাসে পাঠানো হয়। তিনি তাদের উপরে জয়লাভ করেন। কিন্তু তাদের নিক্ষিপ্ত তীরের আঘাতে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তৃতীয় দলটির পিছনে যুবায়ের ইবনুল “আওয়ামের নেতৃত্বে একদল অশ্বারোহীকে নাখলায় পাঠানো হয়। যাদের হাতে তারা পরাভূত হয় এবং তাদের প্রবীণ নেতা দুরাইদ বিন ছিম্মাহ নিহত হন। যিনি যুদ্ধে আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না।
আনছারগণের বিমর্ষতা ও রাসূল (সাঃ)-এর ভাষণ
মক্কার নওমুসলিমদের মধ্যে গণীমতের বৃহদাংশ বণ্টন করে দেওয়ায় আনছারদের মধ্যে কিছুটা বিমর্ষভাব দেখা দেয়। কেউ কেউ বলে ফেলেন, , আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন’। কেউ বলেন, যখন কঠিন সময় আসে, তখন আমাদের ডাকা হয়। আর গণীমত দেওয়া হয় অন্যদের’ (বুখারী হা/৪৩৩৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে “তিনি কুরায়েশদের দিচ্ছেন ও আমাদেরকে পরিত্যাগ করছেন। অথচ আমাদের তরবারী থেকে তাদের রক্ত টপকাচ্ছে’ (বুখারী হা/৪৩৩১)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, খাযরাজ নেতা সাদ বিন ওবাদাহর মাধ্যমে এ খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্রুত তাদের কাছে গমন করেন এবং সমবেত আনছারদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে হামদ ও ছানার পরে বলেন, ‘হে আনছারগণ! তোমাদের কিছু কথা আমার নিকট পৌঁছেছে। তোমাদের অন্তরে আমার বিরুদ্ধে কিছু অসন্তুষ্টি দানা বেঁধেছে’ (আহমাদ হা/১১৭৪৮) হে আনছারগণ! আমি কি তোমাদের নিকটে এমন অবস্থায় আসিনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। তোমরা ছিলে বিভক্ত, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। তোমরা ছিলে অভাবগ্রস্ত, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সচ্ছলতা দান করেন” (বুখারী হা/৪৩৩০)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় আরও এসেছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেন, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন’? তারা বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে আনছারগণ! তোমরা কি জবাব দিবে না? তারা বললেন, আমরা আর কি জবাব দেব হে আল্লাহর রাসূল! এসবই তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগ্রহ। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, দেখ তোমরা ইচ্ছা করলে একথাও বলতে পার এবং সেটা বললে তোমরা অবশ্য সত্য কথাই বলবে- সেটা এই যে, এ এই  আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন এমন সময় যখন আপনাকে মিথ্যাবাদী বলা হচ্ছিল। অতঃপর আমরা আপনাকে সত্য বলে জেনেছি। যখন আপনি ছিলেন অপদস্থ, তখন আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। যখন আপনি ছিলেন বিতাড়িত, তখন আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। যখন আপনি ছিলেন অভাবগ্রস্ত, তখন আমরা আপনার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি’।
অতঃপর তিনি বলেন, হে আনছারগণ! দুনিয়ার এক গোছা ঘাসের জন্য তোমরা মনে কষ্ট নিয়েছ, যার মাধ্যমে আমি লোকদের হৃদয়ে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি, যাতে তারা অনুগত হয়। আর তোমাদেরকে সোপর্দ করেছি তোমাদের ইসলামের নিকট (অর্থাৎ তোমাদের জন্য ইসলামই যথেষ্ট ) হে আনছারগণ! তোমরা কি এতে রার্থী নও যে, লোকেরা বকরী ও উট নিয়ে চলে যাক, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে তোমাদের কাফেলায় ফিরে যাও? তোমরা কি এতে খুশী নও যে, লোকেরা দুনিয়া নিয়ে চলে যাক। আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে চলে যাও ও তাঁকে তোমাদের বাড়ীতে আশ্রয় দাও?’ ‘অতএব সেই সত্ত্বার কসম, যাঁর হাতে রয়েছে মুহাম্মাদের জীবন, যদি হিজরত না থাকত, তাহালে আমি হাতাম আনছারদের একজন। যদি লোকেরা বিভিন্ন গোত্র বেছে নেয়, তবে আমি আনছারদের গোত্রে প্রবেশ করব। ‘হে আল্লাহ! তুমি আনছারদের উপরে রহম কর। আনছারদের সন্তানদের উপর রহম কর এবং তাদের সন্তানদের সন্তানগণের উপর রহম করা।
রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষণ শুনে কাঁদতে কাঁদতে সকলের দাড়ি ভিজে গেল এবং তারা সবাই বলে উঠল, ‘আমরা সবাই আল্লাহর রাসুলের ভাগ-বণ্টনে সন্তুষ্ট’ (আহমাদ হা/১১৭৪৮ সনদ হাসান)।
মদীনায় উপস্থিতি ও মদীনাবাসীর অভিনন্দন
দূর হ’তে দেখতে পেয়ে খুশীতে রাসূল (সাঃ) বলে ওঠেন, ‘এই যে মদীনা, এই যে ওহোদ’ ‘এই পাহাড় আমাদের ভালবাসে এবং আমরা একে ভালবাসি’। মদীনার নারী-শিশু ও বালকেরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বিপুল উৎসাহে রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানান।
উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের সর্বশেষ যুদ্ধ। ৫০ দিনের এই সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে ও ২০ দিন ছিল তাবুকে অবস্থান (আহমাদ হা/১৪১৭২)। রজব মাসে গমন ও রামাযান মাসে প্রত্যাবর্তন।
মদীনায় ফেরার পরবর্তী ঘটনাবলী
(১) মুনাফিকদের ওযর কবুল
মদীনায় পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে দু’রাকাআত নফল ছালাত আদায় করেন। অতঃপর সেখানেই লোকজনের সাথে বসে পড়েন। এ সময় ৮০ জনের। অধিক লোক এসে তাদের যুদ্ধে গমন না করার পক্ষে নানা ওষর-আপত্তি পেশ করে ক্ষমা চাইতে থাকে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের ক্ষমা করে দেন ও আনুগত্যের বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাদের হৃদয়ের গোপন বিষয়সমূহ আল্লাহর উপরে ছেড়ে দেন। তবে এদের ওঘর সমূহ যে কপটতাপূর্ণ ছিল, সে বিষয়ে আল্লাহ সূরা তওবার ১৪-৯৮ আয়াতে বর্ণনা করেছেন এবং রাসূল (সাঃ) রাখী হ’লেও আল্লাহ যে কখনো তাদের উপরে রার্থী হবেন না, সেকথা বলে দেন। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘তারা তোমাদের নিকট শপথ করবে যেন তোমরা তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও। যদি তোমরা তাদের প্রতি রাখী হয়ে যাও, তবু আল্লাহ তো ফাসেক কওমের উপর রায়ী হন না (তওবা ৯/৯৬)। এভাবেই মুনাফিকদের সাথে মুমিনদের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। আল্লাহর ভাষায় আল্লাহ মুমিনদেরকে বর্তমান অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারেন না, যতক্ষণ না অপবিত্র লোকগুলিকে পবিত্রদের থেকে পৃথক করে দেন’ (আলে ইমরান ৩/১৭৯)। অবশ্য আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলবল উক্ত ৮০ জনের বাইরে ছিল। যাদের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী।
(২) পিছনে থাকা তিনজন খাঁটি মুমিনের অবস্থা
আনছারদের তিনজন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তি, যারা স্রেফ সাময়িক বিচ্যুতির কারণে যুদ্ধে গমন থেকে পিছিয়ে ছিলেন, তাঁরা ওর-আপত্তি না তুলে সরাসরি সত্য কথা বলেন। এঁরা হলেন, ১- হযরত কা’ব বিন মালেক, যিনি মক্কায় ঐতিহাসিক বায়আতে আক্কাবায় অংশগ্রহণকারী ৭৩ জন পুরুষ ছাহাবীর অন্যতম ছিলেন। ২- মুরারাহ বিন রবী’ এবং ৩ হেলাল বিন উমাইয়া। এরা ইতিহাসে ‘আল-মুখাল্লায়ূন বা পিছিয়ে থাকা ব্যক্তিগণ’ বলে পরিচিত হয়েছেন।
এঁরা সবাই ছিলেন অত্যন্ত মুখলেছ এবং রাসূল (সাঃ)-এর সাথে বিভিন্ন জিহাদে অংশগ্রহণকারী ছাহাবী। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁদের ওযর কবুল করলেন এবং তাদেরকে পূর্ণ বয়কটের নির্দেশ দিলেন। অতঃপর তাদের তওবা কবুলের বিষয়টি আল্লাহর উপরে ছেড়ে দিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বয়কট চল্লিশ দিন অতিবাহিত হয়। এরি মধ্যে তাদের। অবস্থা কঠিন আকার ধারণ করল। আপনজন ও বন্ধু-বান্ধব কেউ তাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। কথাও বলে না। সালাম দিলেও জবাব দেয় না। মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। এই দুর্বিষহ জীবনে দুঃখে-বেদনায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হবার উপক্রম হয়। চল্লিশ দিনের মাথায় তাদের প্রতি স্ত্রী থেকে পৃথক থাকার নির্দেশ এল। ফলে তারা স্ব স্ব স্ত্রীদের পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। যা তাদের অবস্থাকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলল। তারা সর্বদা আল্লাহর দরবারে কেঁদে বুক ভাসাতে থাকেন। এই বয়কট চলাকালে হযরত কা’ব বিন মালেক আরেকটি কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। গাসসান অধিপতি তাঁর নিকটে একটি পত্র পাঠিয়ে তাদের তিনজনের প্রতি সহানুভূতি জানান এবং কা’বকে তাঁর দরবারে আমন্ত্রণ জানান। পত্রে বলা হয় যে, আমরা জানতে পেরেছি, তোমাদের মনিব তোমাদের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেছেন। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার জন্য রাখেননি এবং তোমাকে নষ্ট করতে চান না। তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমার প্রতি খেয়াল রাখব ও যথোপযুক্ত মর্যাদা দেব’। চিঠি পড়েই কা’ব বলেন, এটাও একটি পরীক্ষা’। তিনি বলেন, এরপর আমি পত্রটা একটা জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করলাম’ (বুখারী হা/৪৪১৮)। অতঃপর ৫০ দিনের মাথায় তাদের খালেছ তওবা কবুল হ’ল এবং নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হ’ল।
“এবং আল্লাহ দয়াশীল হন সেই তিন ব্যক্তির উপরে, যারা (জিহাদ থেকে) পিছনে ছিল। তাদের অবস্থা এমন হয়েছিল যে, প্রশস্ত যমীন তাদের উপরে সংকীর্ণ হয়ে পড়েছিল ও তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। তারা দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করেছিল যে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের অন্য কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর আল্লাহ তদের তওবা কবুল করেন। যাতে তারা ফিরে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বাধিক তওবা কবুলকারী ও অসীম দয়ালু’ (তওবাহ ৯/১১৮)।
তওবা কবুলের উক্ত আয়াত নাযিলের সাথে সাথে মুমিনদের মধ্যে আনন্দের ঢেউ উঠে গেল। সকলে দান-ছাদাকায় লিপ্ত হ’ল। এমন আনন্দ তারা জীবনে পায়নি। এটাই ছিল। যেন তাদের জীবনের সবচেয়ে সৌভাগ্যময় দিন।
কা’ব বিন মালিক তার বাড়ীর ছাদে নিঃসঙ্গভাবে দুঃখে-বেদনায় পড়েছিলেন। এমন সময় নিকটবর্তী সালা’ পাহাড়ের উপর থেকে একজন আহবানকারীর আওয়ায় শোনা গেল- হে কা’ব বিন মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর’।
কা’ব বলেন, এ সংবাদ শুনেই আমি সিজদায় পড়ে যাই। অতঃপর দৌড়ে রাসূল (সাঃ) এর দরবারে চলে যাই। বন্ধু-বান্ধব চারদিক থেকে ছুটে এসে অভিনন্দন জানাতে থাকে। সারা মদীনায় আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হাস্যোজ্জ্বল মুখে আমাকে বলেন  সুসংবাদ গ্রহণ করা জন্মের পর থেকে এমন আনন্দের দিন তোমার জীবনে আর কখনো আসেনি’। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এ (ক্ষমা) আপনার পক্ষ থেকে, না আল্লাহর পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! এর শুকরিয়া স্বরূপ আমি আমার সম্পদ থেকে আল্লাহর রাহে ছাদাক্বা করতে চাই। রাসূল (সাঃ) বললেন, কিছু অংশ রেখে দাও। সেটা তোমার জন্য উত্তম হবে। আমি বললাম, খায়বরের গণীমতের অংশ আমি রেখে দিয়েছি। অতঃপর আমি বললাম, সত্য কথা বলার জন্য আল্লাহ আমাকে নাজাত দিয়েছেন। অতএব আমার তওবা এই যে, যতদিন বেঁচে থাকব কখনই সত্য ছাড়া বলবো না। আল্লাহর কসম! রাসূল (সাঃ)-এর সামনে সত্য বলার আগ পর্যন্ত মুসলমানদের মধ্যে সত্য কথা বলার জন্য আমার মত পরীক্ষা কাউকে দিতে হয়েছে বলে আমি জানতে পারিনি’।
(৩) সত্যিকারের অপারগদের জন্য সুসংবাদ
মদীনায় এমন বহু মুমিন ছিলেন, যারা মনের দিক দিয়ে সর্বক্ষণ রাসূল (সাঃ) -এর সাথী ছিলেন, কিন্তু শারীরিক দুর্বলতা, আর্থিক অপারগতা, বাহনের অপ্রাপ্যতা বা অনিবার্য কোন কারণবশতঃ যুদ্ধে যেতে পারেননি। তাদের এই অক্ষমতার জন্য তারা যেমন দুঃখিত ও লজ্জিত ছিলেন, তেমনি ভীত ছিলেন এজন্য যে, আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন কি না। আল্লাহ তাদের অন্তরের খবর রাখেন। তাই তাদের ক্ষমার সুসংবাদ দিয়ে আয়াত নাযিল হ’ল
“অবশ্যই আল্লাহ দয়াশীল হয়েছেন নবীর প্রতি এবং মুহাজির ও আনছারদের প্রতি, যারা দুঃসময়ে তার অনুসারী হয়েছিল, তাদের এক দলের অন্তর টলে যাওয়ার উপক্রম হওয়ার পর। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি দয়াপরবশ হ’লেন। নিশ্চয়ই তিনি তাদের প্রতি স্নেহশীল ও করুণাময় (তওবাহ ৯/১১৭)। আরও নাযিল হয়,
“কোন অভিযোগ নেই ঐসব লোকদের প্রতি, যারা দুর্বল, রোগী এবং (যুদ্ধের সফরে) ব্যয়ভার বহনে অক্ষম, যখন তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল-এর প্রতি আন্তরিক নিষ্ঠা পোষণ করে। সদাচারী লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (তওবাহ ১/৯১)।
মদীনার কাছাকাছি পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) এইসব লোকদের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এই মদীনায় এমন কিছু লোক রয়েছে, তোমরা যেখানেই সফর করেছ, বা যে উপত্যকা অতিক্রম করেছ, তারা সর্বদা তোমাদের সঙ্গে থেকেছে। ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! তারা মদীনায় থেকেও আমাদের সঙ্গে ছিল? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ তারা মদীনায় থেকেও তোমাদের সঙ্গে ছিল। ওযর তাদেরকে আটকে রেখেছিল’
(৪) মুনাফিকদের প্রতি কঠোর হওয়ার নির্দেশ
তাবুক যুদ্ধের সময় মুনাফিকরা যে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছিল, তা ছিল ক্ষমার অযোগ্য। বিশেষ করে বহিঃশক্তি রোমক বাহিনীকে মদীনা আক্রমণের আহবান জানানো ও তার জন্য ষড়যন্ত্রের আখড়া হিসাবে কোবায় মসজিদে ফেরার’ নির্মাণ ছিল রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক অপরাধ। এ প্রেক্ষিতে এদের অপতৎপরতা যাতে আর বৃদ্ধি পেতে না পারে এবং রাসূল (ছাঃ)-এর উদারতাকে তারা দুর্বলতা না ভাবে, সেকারণ আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে তাদের ব্যাপারে কঠোর হবার নির্দেশ দিয়ে বলেন, “হে নবী! কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ কর ও তাদের প্রতি কঠোর হও। তাদের ঠিকানা হ’ল জাহান্নাম এবং সেটি কতই না মন্দ ঠিকানা’ (তওবাহ ৯/৭৩)। এখানে মুনাফিকদের সাথে জিহাদের অর্থ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, মৌখিক কঠোরতার জিহাদ (ইবনু কাছীর)। কেননা আল্লাহর রাসূল(সাঃ) কখনোই তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করেননি বা তাদেরকে হত্যা করেননি।
(৫) মসজিদে যেরার ধ্বংস
রোমকদের কেন্দ্রভূমি সিরিয়া থেকে ষড়যন্ত্রকারী আবু আমের আর-রাহেব-এর পত্র মোতাবেক মদীনার ১২ জন মুনাফিক কোবা মসজিদের অদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে (কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭)। এটা তাদের চক্রান্ত ও অস্ত্র সংগ্রহের কেন্দ্র হ’লেও সাধারণ মুসলমানদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য তারা এটাকে ‘মসজিদ’ নাম দেয় এবং রাসূল (সাঃ) কে সেখানে গিয়ে ছালাত আদায়ের জন্য দাওয়াত দেয়। অজুহাত হিসাবে তারা বলেছিল যে, এটি তারা নির্মাণ করছে দুর্বলদের জন্য এবং অসুস্থদের জন্য, যারা শীতের রাতে কষ্ট করে দূরের মসজিদে যেতে পারে না তাদের জন্য। তারা বলে, আমরা চাই যে, আপনি সেখানে ছালাত আদায় করুন এবং আমাদের জন্য বরকতের দোআ করুন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সরল মনে তাদের দাওয়াত কবুল করেন এবং তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে ওয়াদা করেন। কিন্তু তাবুক থেকে ফেরার সময় এক ঘণ্টার পথ বাকী থাকতে তিনি যখন মদীনার নিকটবর্তী যু-আওয়ান  নামক স্থানে অবতরণ করেন, তখন তাঁর নিকটে মুনাফিকদের ঐ ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,
“আর যারা মসজিদ তৈরী করেছে ক্ষতি সাধনের জন্য, কুফরী করার জন্য ও মুমিনদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টির জন্য এবং আল্লাহ ও তার রাসূল-এর বিরুদ্ধে পূর্ব থেকেই যুদ্ধকারীদের ঘাঁটি করার জন্য, তারা অবশ্যই শপথ করে বলবে যে, আমরা সদুদ্দেশ্যেই এটা করেছি। অথচ আল্লাহ সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে, ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’। ‘তুমি কখনোই উক্ত মসজিদে দণ্ডায়মান হবে না। যে মসজিদ প্রথম দিন থেকে তাক্বওয়ার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে, সেটাই তোমার (ছালাতের জন্য) দাঁড়াবার যথাযোগ্য স্থান। সেখানে এমন সব লোক রয়েছে, যারা উত্তমরূপে পরিশুদ্ধ হওয়াকে ভালবাসে। বস্তুতঃ আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন’ (তওবাহ ৯/১০৭-০৮)।
প্রকৃত ঘটনা অবহিত হয়ে মদীনায় উপস্থিত হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে মালেক বিন দুখশুম, মা আন বিন আদী, আমের বিন সাকান এবং ওহোদ যুদ্ধে হামযা (রাঃ)-এর হত্যাকারী ওয়াহশী বিন হারবকে নির্দেশ দিলেন মসজিদ নামক উক্ত ষড়যন্ত্রের ঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে ও পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে আসার জন্য ।তারা সঙ্গে সঙ্গে গিয়ে উক্ত গৃহটি সমূলে উৎপাটিত করে পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেন। মসজিদে কোবা থেকে অনতিদূরে উক্ত অভিশপ্ত স্থানটি আজও বিরান পড়ে আছে। এই সময় সূরা তওবায় মুনাফিকদের মুখোশ উন্মোচন করে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। ফলে তারা সমাজে চিহ্নিত হয়ে যায় এবং একেবারেই কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
অতঃপর মাত্র তিন মাসের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ আরও কতগুলি ঘটনা ঘটে। যেমন
(৬) লে আন-এর ঘটনা :  স্বামী যদি স্ত্রীর প্রতি ব্যভিচারের অপবাদ দেয়, আর তার কোন সাক্ষী না থাকে, সে অবস্থায় যে পদ্ধতির মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটানো হয়, তাকে লে’আন বলা হয়। পদ্ধতি এই যে, স্বামী ও স্ত্রী উভয়ে আদালতে বিচারকের সম্মুখে দাঁড়াবে। অতঃপর স্বামী আল্লাহর কসম করে চারবার বলবে যে, সে অবশ্যই সত্যবাদী এবং পঞ্চমবার বলবে, যদি সে মিথ্যাবাদী হয়, তবে তার উপরে আল্লাহর লানত বর্ষিত হৌক (নূর ২৪/৬-৭)। আর ‘স্ত্রীর শাস্তি রহিত হয়ে যাবে যদি সে আল্লাহর কসম করে চারবার বলে যে, তার স্বামী অবশ্যই মিথ্যাবাদী এবং পঞ্চমবারে বলে, যদি তার স্বামী সত্যবাদী হয়, তবে তার উপর আল্লাহর গযব নেমে আসুক’ (নূর ২৪/৮-৯)। হেলাল বিন উমাইয়া এবং ‘উওয়াইমির আজলানীর ঘটনার প্রেক্ষিতে উক্ত আয়াতগুলি নাযিল হয়। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের স্বামী-স্ত্রীকে ডেকে এনে মসজিদের মধ্যে লেআন করান। উভয় পক্ষে পাঁচটি করে সাক্ষ্য পূর্ণ হয়ে লে’আন সমাপ্ত হ’লে উওয়াইমের বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন যদি আমি তাকে স্ত্রীরূপে রাখি, তাহ’লে আমি মিথ্যা অপবাদ দানকারী হয়ে যাব। অতএব আমি তাকে তালাক দিলাম’। হেলাল বিন উমাইয়ার ঘটনায় রাসূল (সাঃ) লোআনের পর স্বামী ও স্ত্রীকে বিচ্ছিন্ন করে দেন। এবং বলেন যে, স্ত্রীর গর্ভের সন্তান স্ত্রীর বলে কথিত হবে- পিতার সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হবে না। তবে সন্তানটিকে ধিকৃত করা যাবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, লে আনকারীদ্বয় পৃথক হ’লে তারা কখনোই আর একত্রিত হাতে পারবে না’।বিচারক বিবাহ বিচ্ছিন্ন করে দেবার পর ইদ্দত পূর্ণ করে উক্ত স্ত্রী অন্যত্র বিবাহ করতে পারবে। এভাবে লেআনের মাধ্যমে সে দুনিয়ার শাস্তি থেকে বাঁচলেও আখেরাতের শাস্তি বেড়ে যাবে।
(৭) গামেদী মহিলার ব্যভিচারের শাস্তি : গামেদী মহিলার ব্যভিচারের শাস্তি দানের বিখ্যাত ঘটনাটি এ সময়ে সংঘটিত হয়। উক্ত মহিলা ইতিপূর্বে নিজে এসে ব্যভিচারের স্বীকৃতি দেয় ও গর্ভধারণের কথা বলে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে সন্তান প্রসবের পর আসতে বলেন। অতঃপর ভূমিষ্ট সন্তান কোলে নিয়ে এলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে দুধ ছাড়ানোর পর বাচ্চা শক্ত খাবার খেতে শিখলে পরে আসতে বলেন। অতঃপর বাচ্চার হাতে রুটিসহ এলে এবং রাসূল (সাঃ) -এর আহবানে জনৈক আনছার ছাহাবী ঐ বাচ্চার লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করলে তাকে ব্যভিচারের শাস্তি স্বরূপ প্রস্তরাঘাতে হত্যা করা হয়।
প্রস্তরাঘাতে ফেটে যাওয়া মাথার রক্তের ছিটা খালেদ বিন অলীদের মুখে এসে লাগলে তিনি গালি দিয়ে কিছু মন্তব্য করেন। তাতে রাসূল (সাঃ) তাকে ধমক দিয়ে বলেন, ৮১৮ এয়ার এ থাম হে খালেদ! যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, এই মহিলা এমন তওবা করেছে, যদি রাজস্ব আদায়ে খেয়ানতকারী ব্যক্তিও এমন তওবা করত, তাহ’লে তাকেও ক্ষমা করা হ’ত’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জানাযা পড়েন। তখন ওমর (রাঃ) বলেন, ‘হে আল্লাহর নবী! আপনি তার জানাযা পড়লেন? অথচ সে যেনা করেছে? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এ মহিলা এমন তওবা করেছে যে, তা সত্তর জন মদীনাবাসীর মধ্যে বণ্টন করে দিলেও যথেষ্ট হয়ে যেত। তুমি কি এর চাইতে উত্তম কোন তওবা পাবে, যে ব্যক্তি স্রেফ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছে?’ বস্তুতঃ পরকালের কঠিন শাস্তি হাতে বাঁচার জন্য দুনিয়ায় প্রাণদন্ডের মত কঠোরতম শাস্তি স্বেচ্ছায় বরণ করার এ আকুতি পৃথিবীর কোন সমাজব্যবস্থায় পাওয়া যাবে কি?
(৮) নবীকন্যা উম্মে কুলছুমের মৃত্যু: রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কন্যা উম্মে কুলছুম এসময় নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার মৃত্যুতে গভীরভাবে শোকাভিভূত হন। জামাতা ওছমান গণীকে তিনি বলেন, ‘আমার আর কোন মেয়ে থাকলে তাকেও আমি তোমার সাথে বিবাহ দিতাম’ (আল-বিদায়াহ
উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর দ্বিতীয়া কন্যা এবং ওছমান (রাঃ)-এর প্রথমা স্ত্রী রুকাইয়া মাত্র ২১ বছর বয়সে ২য় হিজরীর রামাযান মাসে বদরের যুদ্ধের সুসংবাদ মদীনায় পৌঁছার দিন মারা যান। অতঃপর ৩য় হিজরীতে ওছমানের সাথে উম্মে কুলছুমের বিবাহ হয়। ৯ম হিজরীতে তার মৃত্যুর পরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এতই ব্যথিত হন যে, তিনি কবরের পাশে বসে পড়েন। এ সময় তাঁর গন্ড বেয়ে অবিরলধারে অজ্ঞবন্যা বয়ে যাচ্ছিল।
(৯) ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু: এ সময় মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মৃত্যু হয়। তার ছেলে আব্দুল্লাহ, যিনি উত্তম ছাহাবী ছিলেন, তার দাবী অনুযায়ী তার কাফন পরানোর জন্য রাসূল (সাঃ) নিজের ব্যবহৃত জামা তাকে প্রদান করেন ও জানাযা পড়তে সম্মত হন। অতঃপর তিনি জানাযায় গমনের জন্য উঠে দাঁড়ালে ওমর (রাঃ) তাঁর কাপড় টেনে ধরে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আপনি তার জানাযার ছালাত আদায় করবেন, অথচ আল্লাহ কি আপনাকে মুনাফিকদের জানাযা পড়তে নিষেধ করেন নি? তখন মুচকি হেসে রাসূল (সাঃ) বললেন, সরে যাও হে ওমর! আমাকে এ ব্যাপারে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে। যদি আমি জানতাম ৭০ বারের অধিক মাগফেরাত কামনা (তওবা ৯/৮০) করলে তাকে ক্ষমা করা হবে, তাহালে আমি তার চেয়ে অধিকবার ক্ষমা চাইতাম। ওমর বললেন, সে তো মুনাফিক! অতঃপর রাসূল (সাঃ) তার জানাযার ছালাত আদায় করলেন এবং ফিরে এলেন। এর কিছু পরেই মুনাফিকদের জানাযায় অংশগ্রহণের উপরে চূড়ান্ত নিষেধাজ্ঞা জারী করে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়,
তাদের মধ্যে কারু মৃত্যু হ’লে কখনোই তার জানাযা পড়বে না এবং তার কবরে দাঁড়াবে না। তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি কুফরী করেছে (অর্থাৎ তাঁর বিধানকে প্রত্যাখ্যান করেছে)। আর তারা মৃত্যুবরণ করেছে পাপাচারী অবস্থায়’ (তওবা ৯/৮৪)। আরও নাযিল হয়, তুমি তাদের জন্য ক্ষমা চাও বা না চাও, দু’টিই তাদের জন্য সমান। আল্লাহ কখনোই তাদের ক্ষমা করবেন না। নিশ্চয়ই আল্লাহ ফাসেক সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (মুনাফিকুন ৬৩/৬)। এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আর কোন মুনাফিকের জানাযা পড়েননি।
ওমর (রাঃ)-এর এরূপ বলার কারণ, ইতিপূর্বে আয়াত নাযিল হয়েছিল যে, নবী বা কোন মুমিনের জন্য উচিত নয় যে, তারা মুশরিকদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুক’ (তওবা ৯/১১৩)। উক্ত আয়াত মক্কায় নাযিল হয়েছিল আবু ত্বালিবের মৃত্যুর সময়। সম্ভবতঃ তার উপরে ভিত্তি করেই ওমর (রাঃ) এরূপ কথা বলে থাকবেন (কুরতুবী, তাফসীর সূরা তওবা ৮৪ আয়াত)।
আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর এরূপ সদাচরণের কারণ তিনি নিজেই উল্লেখ করেছেন। যেমন তিনি বলেন, আমার জামা তাকে আল্লাহর আযাব থেকে বাঁচাতে পারবে না। তবে আমি একাজটি এজন্য করেছি, আমার আশা যে, এর ফলে তার গোত্রের বহু লোক মুসলমান হয়ে যাবে। ইবনু ইসহাক তার মাগাধীতে এবং কোন কোন তাফসীর গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল (সাঃ) -এর এই সদাচরণ দেখে ইবনু উবাইয়ের খাযরাজ গোত্রের এক হাযার লোক মুসলমান হয়ে যায়।
এর আরও কারণ থাকতে পারে। জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে এসেছে যে, বদরের যুদ্ধে বন্দী রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস এর জন্য একটি জামার প্রয়োজন হ’লে কারু জামা তার গায়ে হয়নি। আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের দেওয়া জামাটিই আববাসের গায়ের জন্য উপযুক্ত হয়’। সেদিনের সেই দানের প্রতিদান হিসাবে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) নিজের জামা তাকে দিয়ে দেন। ইবনু উয়ায়না বলেন, রাসূল (ছাঃ)-এর প্রতি আব্দুল্লাহ বিন উবাইয়ের এটি সৌজন্য ছিল, তাই তিনি তার প্রতিদান দিতে চেয়েছিলেন
(১০) আবুবকরের হজ্জ ; বিধি-বিধান সমূহ জারী :
হজ্জের বিধি-বিধান জারী করার উদ্দেশ্যে ৯ম হিজরীতে হজ্জের মৌসুমে আবুবকর (রাঃ)-কে ‘আমীরুল হাজ্জ’ হিসাবে মক্কায় পাঠানো হয়। তাদের রওয়ানা হবার পরপরই সূরা তওবাহর প্রথম দিকের আয়াতগুলি নাযিল হয়। যাতে মুশরিকদের সঙ্গে সম্পাদিত ইতিপূর্বেকার সকল চুক্তি বাতিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। ফলে সে যুগের নিয়মানুযায়ী রাসূল (ছাঃ)-এর রক্ত সম্পর্কীয় হিসাবে হযরত আলীকে পুনরায় পাঠানো হয়। কেননা পরিবার বহির্ভূত কোন ব্যক্তির মাধ্যমে চুক্তি বাতিলের ঘোষণা সে যুগে স্বীকৃত ছিল না বা
কার্যকর হাত না। আরাজ | অথবা যাজনান উপত্যকায় গিয়ে আলী (রাঃ) হযরত আবুবকর (রাঃ)-এর কাফেলার সাথে মিলিত হন। তখন আবুবকর (রাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আমীর হিসাবে এসেছেন না মামুর হিসাবে?” আলী (রাঃ) বললেন, ‘না। বরং মা’মুর হিসাবে’।
অতঃপর হজ্জের বিধি-বিধানসমূহ জারী করার ব্যাপারে আবুবকর (রাঃ) তাঁর দায়িত্ব পালন করলেন। এরপর কুরবানীর দিন হযরত আলী (রাঃ) কংকর নিক্ষেপের স্থান জামরার নিকটে দাঁড়িয়ে রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষে সূরা তওবাহর প্রথম দিককার সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি পড়ে শুনান এবং পূর্বের সকল চুক্তি বাতিলের ঘোষণা দেন। তিনি চুক্তিবদ্ধ ও চুক্তিবিহীন সকলের জন্য চার মাসের সময়সীমা বেঁধে দেন। যাতে এই সময়ের মধ্যে মুশরিকরা চুক্তিতে বর্ণিত বিষয়সমূহ নিষ্পত্তি করে ফেলে। তবে যেসব মুশরিক। অঙ্গীকার পালনে কোন ত্রুটি করেনি বা মুসলমানদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের চুক্তিনামা পূর্বনির্ধারিত সময় পর্যন্ত বলবৎ রাখা হয়। অতঃপর আবুবকর (রাঃ) একদল লোক পাঠিয়ে ঘোষণা জারী করেন যে, এখন থেকে আর কোন মুশরিক কা’বাগৃহে হজ্জ করতে পারবে না এবং কোন ব্যাক্তি নগ্ন অবস্থায় কা’বাগৃহ তাওয়াফ করতে পারবে না’। এর ফলে মূর্তিপূজা চিরকালের জন্য নিষিদ্ধ হ’ল। মূলতঃ ৯ম হিজরীর এই হজ্জ ছিল পরবর্তী বছর রাসূল (সাঃ)-এর বিদায় হজ্জের প্রাথমিক পর্ব। যাতে ঐ সময় মুশরিকমুক্ত অবস্থায় হজ্জ সম্পন্ন করা যায় এবং মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দেওয়া যায়।
বিদায় হজ্জ ((১০ম হিজরীর যিলহজ্জ মাস)
মক্কা বিজয়ের পর থেকেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায়ের আশংকা করছিলেন। এরি মধ্যে রাষ্ট্রীয় সব কাজকর্ম করে যাচ্ছিলেন। ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি-বিধান সমূহ নাযিল ও তার বাস্তবায়ন সুচারুরূপে সম্পন্ন হয়ে চলছিল। যেহেতু তিনি শেষনবী ও বিশ্বনবী, তাই শুধুমাত্র জান্নাতের সুসংবাদদাতা বা জাহান্নামের ভয় প্রদর্শনকারী হিসাবে নয়, বরং আল্লাহর দ্বীনের বাস্তব রূপকার হিসাবে তাঁর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ মানব জাতির জন্য একটা আদর্শ সমাজের দৃষ্টান্ত স্থাপন করাও সম্ভবতঃ আল্লাহ পাকের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই উন্নত সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার কাঠামো নির্মাণ সম্পন্ন হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে তাঁর যোগ্য উত্তরসুরী খলীফাগণ উক্ত কাঠামোকে ভিত্তি করে আরও সুন্দররূপে ইসলামী খেলাফত ও সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলবেন, এ আশা রেখেই তিনি উম্মতকে অছিয়ত করে বলেন,
ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) হাতে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন আমাদের নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসলেন। অতঃপর আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ভাষায় ওয়ায করলেন যে, চক্ষুসমূহ অশ্রুসজল হ’ল এবং হৃদয় সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে গেল। এমন সময় জনৈক মুছল্লী বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! মনে হচ্ছে যেন এটি কোন বিদায় গ্রহণকারীর অন্তিম উপদেশ। অতএব আপনি আমাদেরকে আরও বেশী উপদেশ দিন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমি তোমাদেরকে আল্লাহভীতির উপদেশ দিচ্ছি এবং তোমাদের আমীরের আদেশ শুনতে ও তা মান্য করতে উপদেশ দিচ্ছি, যদিও তিনি একজন হাবশী গোলাম হন। কেননা আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা বেঁচে থাকবে, তারা সত্বর বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আকড়ে ধরবে। তাকে কঠিনভাবে ধরবে এবং মাড়ির দাঁত সমূহ দিয়ে কামড়ে ধরে থাকবে। সাবধান! দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি সমূহ হ’তে বিরত থাকবে। কেননা (দ্বীনের ব্যাপারে) যেকোন নতুন সৃষ্টি হ’ল বিদাআত এবং প্রত্যেক বিদ’আত হ’ল ভ্রষ্টতা’। জাবের (রাঃ) কর্তৃক নাসাঈ-র বর্ণনায় এসেছে, আর প্রত্যেক ভ্রষ্টতার পরিণাম হ’ল জাহান্নাম’।
ইরবায বিন সারিয়াহ (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমি তোমাদেরকে স্বচ্ছ দ্বীনের উপর ছেড়ে যাচ্ছি। যার রাত্রি হ’ল দিবসের ন্যায়। আমার পরে এই দ্বীন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে না ধ্বংসন্মুখ ব্যক্তি ব্যতীত …
উপরোক্ত অছিয়তের মধ্যে ৫টি বিষয় রয়েছে। (১) সর্বক্ষেত্রে আল্লাহভীরুতা অবলম্বন করা (২) আমীর বা শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করা (৩) মতভেদের সময় রাসূল (সাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত অনুসরণ করা (৪) ইসলামের মধ্যে নবোদ্ভূত বিষয় সমূহ সৃষ্টি তথা যাবতীয় বিদ’আত উদ্ভাবন থেকে বিরত থাকা (৫) বিদআত ছেড়ে রাসূল (সাঃ) ও খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত হাতে-দাঁতে কামড়ে ধরা এবং তাঁদের ও সালাফে ছালেহীনের বুঝ অনুযায়ী শরীআতের ব্যাখ্যা করা।
উক্ত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে শাসক মুসলিম বা অমুসলিম, মুমিন বা ফাসেক দুইই হ’তে পারেন। সর্বাবস্থায় তার প্রতি আনুগত্য বজায় রাখতে হবে সামাজিক শৃংখলার স্বার্থে। এছাড়া মুসলিম নাগরিকগণ সর্বাবস্থায় তাদের সামাজিক জীবন যাপন করবেন জামা আতবদ্ধভাবে একজন আল্লাহভীরু যোগ্য আমীরের অধীনে। যেভাবে মাক্কী জীবনে তারা রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশনায় জীবন যাপন করতেন। অতঃপর তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেন। বাধ্যগত অবস্থায় ধৈর্য ধারণ করবেন ও আল্লাহর নিকট তার হক চাইবেন এবং ক্ষমা প্রার্থনা করবেন। কিন্তু বিদ্রোহ ও বিশৃংখলা সৃষ্টি করবেন না। কেননা আল্লাহ বলেন, আখেরাতের এই গৃহ (অর্থাৎ জান্নাত) আমরা প্রস্তুত করে রেখেছি ঐসব মুমিনের জন্য, যারা দুনিয়াতে ঔদ্ধত্য 3 প্রকাশ করে না এবং বিশৃংখলা কামনা করে না। আর শুভ পরিণাম হ’ল কেবল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (কাছাছ ২৮/৮৩)।
অতঃপর উম্মতের সবাইকে বা অধিকাংশকে একত্রিত করে তাদের সম্মুখে সর্বশেষ উপদেশবাণী প্রদান করা এবং সেই সাথে চির বিদায় নেবার আগ্রহে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) হজ্জে গমনের আকাংখা ব্যক্ত করলেন। সেই সাথে তিনি উম্মতের কাছ থেকে এ সাক্ষ্য নিতে চাইলেন যে, তিনি তাদের নিকটে আল্লাহ প্রেরিত দ্বীন যথাযথরূপে পৌঁছে দিয়েছেন। যদিও আল্লাহ বড় সাক্ষী। রাসূল (সাঃ) হজ্জে যাবেন এবং তিনি উম্মতের সামর্থ্যবান সবাইকে শেষবারের মত একবার পেতে চান ও দেখতে চান- এ ঘোষণা প্রচারের সাথে সাথে চারদিকে ঢেউ উঠে গেল। দলে দলে মানুষ মক্কা অভিমুখে ছুটলো। মদীনা ও আশপাশের লোকেরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথী হ’ল। এই সময়েও আল্লাহর রাসূল (সাঃ) রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে শৈথিল্য দেখাননি। মুআয বিন জাবাল (রাঃ)-কে ইয়ামনের গবর্ণর নিয়োগ দিয়ে পাঠালেন এবং প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দান শেষে বললেন, ‘হে মু’আয! এ বছরের পর তোমার সঙ্গে আমার হয়ত আর সাক্ষাৎ হবে না। তখন হয়ত তুমি আমার এই মসজিদ ও কবরের পাশ দিয়ে অতিক্রম করবে’। অর্থাৎ জীবিত রাসূলকে আর দেখতে পাবে না। মৃত রাসূল-এর কবর যেয়ারতে হয়ত তোমরা আসবে। রাসূল (সাঃ)-এর মুখে এই কথা শুনে ভক্ত ছাহাবী মু’আয ভবিষ্যৎ বিচ্ছেদ বেদনায় হু হু করে কেঁদে উঠলেন। রাসূল (সাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন ‘কেঁদ না হে মু’আয! নিশ্চয় কান্না শয়তানের পক্ষ থেকে আসে’।  এর দ্বারা ‘অধিক কান্না ও শোক’ বুঝানো হয়েছে (বুখারী হা/১২৯৭)। কেননা স্বাভাবিক কান্না আল্লাহর রহমত স্বরূপ (বুখারী হা/১৩০৩)।
হজ্জের উদ্দেশ্যে রওয়ানা
আবু দুজানা সা‘এদী অথবা সিবা’ বিন উরফুত্বাহ গেফারীকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে ১০ম হিজরীর ফুলকা দাহ মাসের ছয় দিন বাকী থাকতে (অর্থাৎ ২৪শে যুলক্বাদাহ) শনিবার যোহরের পর রাসূল (সাঃ) স্ত্রীগণসহ ছাহাবায়ে কেরাম সমভিব্যাহারে মক্কার পথে রওয়ানা হ’লেন (যাদুল মাআদ ২/৯৮-৯৯)। অতঃপর মদীনা থেকে ১০ কি. মি. দক্ষিণে যুল-হুলায়ফা’ গিয়ে আছরের পূর্বে যাত্রাবিরতি করেন। এটা হ’ল মদীনাবাসীদের জন্য হজ্জের মীক্বাত। গলায় মালা পরানো কুরবানীর পশু সঙ্গে ছিল। এখানে তিনি রাত্রি যাপন করেন। পরদিন রবিবার দুপুরের পূর্বে ইহরামের জন্য গোসল করেন এবং গোসল শেষে হযরত আয়েশা (রাঃ) নিজ হাতে তাঁর সারা দেহে ও পোষাকে সুগন্ধি মাখিয়ে দেন। অতঃপর তিনি যোহরের দু’রাক’আত ছালাত আদায় করেন এবং মুছাল্লায় থাকা অবস্থাতেই হজ্জ ও ওমরাহর জন্য একত্রে ইহরাম বাঁধেন ও সেমতে তালবিয়া’ পাঠ করেন। অর্থাৎ “লাব্বায়েক হাজ্জান ও ওমরাতান’ ধ্বনি উচ্চারণ করেন ও হজ্জে কেরান-এর নিয়ত করেন।  যোহরের দু’রাক’আত ফরয ব্যতীত ইহরামের জন্য পৃথকভাবে দু’রাক’আত ছালাত আদায় করেছেন মর্মে রাসূল (সাঃ) থেকে কিছুই বর্ণিত হয়নি।
অতঃপর তিনি বের হন এবং স্বীয় ক্বাছওয়া, উটনীর উপরে সওয়ার হয়ে পুনরায় তালবিয়া পাঠ করেন। অতঃপর খোলা ময়দানে এসে পুনরায় ‘তালবিয়া” বলেন। অতঃপর মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন এবং মধ্যম গতিতে সাত দিন চলে ৩রা যিলহাজ্জ শনিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে মক্কার নিকটবর্তী ‘যূ-তুওয়া’ তে অবতরণ করেন ও সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন রবিবার দিনের বেলায় তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন’ ফলে মদীনা থেকে মক্কায় প্রবেশ পর্যন্ত মোট সফরকাল হয় নয় দিন
আরাফাতে অবস্থান
৯ই যিলহাজ্জ শুক্রবার সকালে তিনি মিনা হ’তে আরাফাতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং ওয়াদিয়ে নামেরায়  অবতরণ করেন। যার একপাশে আরাফাত ও অন্যপাশে মুযদালিফাহ অবস্থিত। অতঃপর সূর্য ঢলে পড়লে তিনি কাছওয়ার পিঠে সওয়ার হয়ে আরাফাত ময়দানের বাতুনে ওয়াদীতে গমন করেন। এটি ছিল একটি পাহাড়ী টিলা। যা বর্তমানে ‘জাবালে রহমত’ বলে খ্যাত। অতঃপর তিনি সেখানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় উপস্থিত মুসলমানদের উদ্দেশ্যে সারগর্ভ ভাষণ দেন (যাদুল মা’আদ ২/২১৫)। এসময় সেখানে এক লক্ষ চবিবশ হাযার বা ত্রিশ হাযার মুসলমান উপস্থিত ছিলেন। মুবারকপুরী কোনরূপ সূত্র ছাড়াই এক লক্ষ অথবা এক লক্ষ চুয়াল্লিশ হাযার বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪৪৪ পৃঃ)।
আরাফাতের ভাষণ
১. জুবায়ের বিন মুত’ইম (রাঃ) বলেন, আরাফার দিন বিদায় হজ্জের ভাষণে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
(১) ‘হে জনগণ! আল্লাহর কসম, আমি জানিনা আজকের পরে আর কোনদিন তোমাদের সঙ্গে এই স্থানে মিলিত হ’তে পারব কি-না। অতএব আল্লাহ রহম করুন ঐ ব্যক্তির উপরে যে ব্যক্তি আজকে আমার কথা শুনবে ও তা স্মরণ রাখবে। কেননা অনেক জ্ঞানের বাহক নিজে জ্ঞানী নয় (সে অন্যের নিকট জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়) এবং অনেক জ্ঞানের বাহক তার চাইতে অধিকতর জ্ঞানীর নিকটে জ্ঞান বহন করে নিয়ে যায়। (২) জেনে রেখ, নিশ্চয়ই তোমাদের মাল-সম্পদ ও তোমাদের রক্ত তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৩) জেনে রেখ, তিনটি বিষয়ে মুমিনের অন্তর খিয়ানত করে না : (ক) আল্লাহর উদ্দেশ্যে এখলাছের সাথে কাজ করা। (খ) শাসকদের জন্য কল্যাণ কামনা করা এবং (গ) মুসলমানদের জামা আতকে অাঁকড়ে ধরা। কেননা তাদের দো’আ তাদেরকে পিছন থেকে (শয়তানের প্রতারণা হাতে) রক্ষা করে’ (দারেমী হা/২২৭, সনদ ছহীহ)। অর্থাৎ মুমিন যতক্ষণ উক্ত তিনটি স্বভাবের উপরে দৃঢ় থাকবে, ততক্ষণ তার অন্তরে খিয়ানত বা বিদ্বেষ প্রবেশ করবে না। যা তাকে ইলম প্রচারের কাজে বাধা দেয়। আর তিনিই হবেন কামেল মুমিন’ (মিরআত হা/২২৯-এর ব্যাখ্যা)।
ছাহেবে মিরক্বাত বলেন, অর্থ আক্বীদা ও সৎকর্মে সকলে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং জুম’আ, জামাআত ও অন্যান্য বিষয়ে সকলে অংশগ্রহণ করা। অর্থ তাদের দোআ তাদেরকে শয়তানী প্রতারণা এবং পথভ্রষ্টতা হাতে পিছন থেকে তাদের রক্ষা করে। এর মধ্যে ধর্মকি রয়েছে, যে ব্যক্তি জামা’আত থেকে বেরিয়ে যাবে, সে ব্যক্তি জামাআতের বরকত ও মানুষের দোআ থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়াও এর মধ্যে ইঙ্গিত রয়েছে যে, জামা’আতবদ্ধ জীবন যাপন করা অধিক উত্তম বিচ্ছিন্ন থাকার চাইতে’। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে। অর্থাৎ তাদের পিছনে যারা আছে, তারা তাকে রক্ষা করে। ত্বীবী বলেন, এর দ্বারা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা আতকে বুঝানো হয়েছে। যাদের দোআ তাদের পরবর্তী বংশধরগণকেও পথভ্রষ্টতা হাতে রক্ষা করে’ (মিরকাত, শরহ মিশকাত হা/২২৮-এর ব্যাখ্যা)।
২. জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের দিন সূর্য ঢলে যাওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ক্বাছওয়া  উটনীর পিঠে সওয়ার হয়ে বাত্বনুল ওয়ার্দীতে আরাফাহ ময়দানে আসেন। অতঃপর লোকদের উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে তিনি বলেন,
হে জনগণ! নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত ও মাল-সম্পদ তোমাদের পরস্পরের উপরে হারাম, যেমন আজকের এই দিন, এই মাস, এই শহর তোমাদের জন্য হারাম’ (অর্থাৎ এর সম্মান বিনষ্ট করা হারাম)। (৪) শুনে রাখ, জাহেলী যুগের সকল কিছু আমার পায়ের তলে পিষ্ট হ’ল। জাহেলী যুগের সকল রক্তের দাবী পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের রক্ত সমূহের প্রথম যে রক্তের দাবী আমি পরিত্যাগ করছি, তা হ’ল রাবী’আহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুতালিব-এর শিশু পুত্রের রক্ত। যে তখন বনু সাদ  গোত্রে দুগ্ধ পান করছিল, আর হোয়াইল গোত্রের লোকেরা তাকে হত্যা করেছিল’। (৫) জাহেলী যুগের সকল সূদ পরিত্যক্ত হ’ল। আমাদের সূদ সমূহের প্রথম যে সূদ আমি শেষ করে দিচ্ছি সেটি হ’ল (আমার চাচা) আববাস বিন আব্দুল মুত্তালিবের পাওনা সুদ। যার সবটুকুই বাতিল করা হ’ল। (৬) ‘তোমরা নারীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর। কেননা তোমরা তাদেরকে আল্লাহর আমানত হিসাবে গ্রহণ করেছ এবং আল্লাহর কালেমার মাধ্যমে তাদেরকে হালাল করেছ। তাদের উপরে তোমাদের প্রাপ্য হক হ’ল এই যে, তারা তোমাদের বিছানা এমন কাউকে মাড়াতে দেবে না, যাদেরকে তোমরা অপছন্দ কর। যদি তারা সেটা করে, তবে তোমরা তাদের প্রহার করবে যা গুরুতর হবে না। আর তোমাদের উপরে তাদের প্রাপ্য হক হ’ল উত্তমরূপে খাদ্য ও পরিধেয় প্রদান করা’। (৭) আর জেনে রাখ, আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি এমন এক বস্তু, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। সেটি হ’ল আল্লাহর কিতাব’। (৮) আর তোমরা আমার সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে। তখন তোমরা কি বলবে? লোকেরা বলল, আমরা সাক্ষ্য দিব যে, আপনি সবকিছু পৌঁছে দিয়েছেন, (রিসালাতের আমানত) আদায় করেছেন এবং উপদেশ দিয়েছেন’। অতঃপর তিনি শাহাদাত অঙ্গুলী আসমানের দিকে উঁচু করে অতঃপর সমবেত জনমন্ডলীর দিকে নীচু করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক’ (তিনবার)
৩. ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,
(৯) ‘আমি কি তোমাদেরকে মুমিন সম্পর্কে খবর দিব না? সে ঐ ব্যক্তি যার হাত থেকে অন্যদের মাল ও জান নিরাপদ থাকে। আর মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে
অন্যেরা নিরাপদ থাকে। আর মুজাহিদ সেই, যে আল্লাহর আনুগত্যে নিজেকে সর্বাত্মকভাবে নিয়োজিত করে এবং মুহাজির সেই, যে সকল প্রকার অন্যায় ও পাপকর্ম সমূহ পরিত্যাগ করে’।
উক্ত কথাটি আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ)-এর বর্ণনায় অন্যভাবে এসেছে, মুসলিম সেই, যার যবান ও হাত থেকে অন্য মুসলমান নিরাপদ থাকে এবং মুহাজির সেই, যে আল্লাহর নিষেধ সমূহ পরিত্যাগ করে।
৪. আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, আরাফাতের ময়দানে উটনীর পিঠে সওয়ার অবস্থায় প্রদত্ত ভাষণে রাসূল (সাঃ) বলেন,
(১০) ‘মনে রেখ! আমি তোমাদের সকলের আগেই হাউয কাউছারে পৌঁছে যাব। আর আমি অন্য সকল উম্মতের মধ্যে তোমাদের আধিক্য নিয়ে গর্ব করব। অতএব তোমরা আমার চেহারাকে কালেমালিপ্ত করো না। (১১) মনে রেখ! আমি অনেককে সেদিন মুক্ত করব এবং অনেকে সেদিন আমার থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। তখন আমি বলব, ‘হে আমার প্রতিপালক! এরা তো আমার সাথী। তিনি বলবেন, তুমি জানো না তোমার পরে এরা (ইসলামের মধ্যে) কত বিদআত সৃষ্টি করেছিল’ (ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৭)।
সাহল বিন সা’দ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এ জওয়াব পাওয়ার পর রাসূল (সাঃ) বলবেন, দূর হও দূর হও! যে ব্যক্তি আমার পরে আমার দ্বীনকে পরিবর্তন করেছ’।
৫. মিখনাফ বিন সুলায়েম (রাঃ) বলেন,
(১২) ‘আমরা আরাফাতের ময়দানে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দাঁড়িয়েছিলাম। অতঃপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম যে, হে জনগণ! নিশ্চয় প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছর একটি করে কুরবানী ও ‘আতীরাহ’।
৬. সুলায়মান বিন আমর ইবনুল আহওয়াছ তার পিতা হ’তে বর্ণনা করেন যে, এদিন রাসূল (সাঃ) আরও বলেন,
(১৩) আজকে কোন দিন? লোকেরা বলল, হাজ্জে আকবারের দিন। তিনি বললেন, নিশ্চয়ই তোমাদের রক্ত, সম্পদ ও (১৪) সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম। যেমন এই দিন ও এই শহর তোমাদের জন্য হারাম। মনে রেখ, অপরাধের শাস্তি অপরাধী ব্যতীত অন্যের উপরে বর্তাবে না। পিতার অপরাধের শাস্তি পুত্রের উপর এবং পুত্রের অপরাধের শাস্তি পিতার উপর বর্তাবে না’। (১৫) “মনে রেখ, শয়তান তোমাদের এই শহরে পূজা পাওয়া থেকে (অর্থাৎ তোমাদের কাফের হওয়া থেকে) চিরদিনের মত নিরাশ হয়ে গেছে। তবে যেসব কাজগুলিকে তোমরা তুচ্ছ মনে কর, সেসব কাজে তার আনুগত্য করা হবে, আর তাতেই সে খুশী থাকবে’। যেমন মিথ্যা, প্রতারণা, আপোষে ঝগড়া-মারামারি ইত্যাদি। যা পরবর্তীদের মধ্যে ঘটেছিল (মির’আত)। জাবের (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনা বাকী থাকবে’  (১৬) একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, মনে রেখা এক মুসলিম আরেক মুসলিমের ভাই। অতএব কোন মুসলমানের জন্য তার ভাই-এর কোন বস্তু হালাল নয় কেবল অতটুকু ব্যতীত যতটুকু সে তার জন্য হালাল করে’ (তিরমিযী হা/৩০৮৭)। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে  কোন ব্যক্তির মাল তার ভাই-এর জন্য হালাল নয়। যতক্ষণ না সে তাকে খুশী মনে তা দেয়। আর তোমরা যুলুম করো না…। এদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সওয়ারীর পিঠে বসে একটি খুত্বা দিয়েছিলেন, দু’টি খুত্বা নয়। এতে প্রমাণিত হয় যে, মুসফিরের জন্য জুম’আর ছালাত অপরিহার্য নয় (যাদুল মা’আদ ২/২১৬)।
আরাফাতের ভাষণে উপরে বর্ণিত ৬টি হাদীছের মধ্যে আমরা ১৬টি বিষয়ে রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্য পেয়েছি। যার প্রতিটিই ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
উল্লেখ্য যে, আরাফাতের ময়দানে রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত ভাষণ উচ্চকণ্ঠে জনগণকে শুনিয়েছিলেন রাবী’আহ বিন উমাইয়া বিন খালাফ’। আল্লাহর কি অপূর্ব মহিমা! মক্কায় হযরত বেলালের উপরে লোমহর্ষক নির্যাতনকারী, রাসূল (ছাঃ)-কে হত্যার ষড়যন্ত্রকারী ১৪ নেতার অন্যতম নিকৃষ্টতম নেতা ও বদর যুদ্ধে নিহত উমাইয়া বিন খালাফের ছেলে রাবী’আহ আজ রাসূল (সাঃ)-এর দেহরক্ষী ছাহাবী ও তাঁর বিদায়ী ভাষণ প্রচারকারী। সুবহা-নাল্লা-হি ওয়া বিহামদিহী, সুবহা-নাল্লা-হিল আযীম।
ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার সনদ নাযিল
এদিন অর্থাৎ জুম’আর দিন সন্ধ্যায় আল্লাহর পক্ষ হ’তে নাযিল হয় এক অনন্য দলীল, ইসলামের পরিপূর্ণতার সনদ, যা ইতিপূর্বে কোন এলাহী ধর্মের জন্য নাযিল হয়নি। এ সময় ‘অহি’ নাযিলের গুরুভার বহনে অপারগ হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর বাহন ‘আযবা’ আস্তে করে বসে পড়ে। অতঃপর ‘অহি’ নাযিল হ’ল
“আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপরে আমার নোমতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’। একারণে বিদায় হজ্জকে ‘হাজ্জাতুল ইসলাম বা ‘ইসলামের হজ্জ’ বলা হয় (আল-বিদায়াহ ৫/১০৯)।
উক্ত আয়াত নাযিলের বিষয়ে পরবর্তীতে ইহুদীরা ওমর ফারূক (রাঃ)-কে বলেন, ‘হে আমীরুল মুমিনীন! যদি উক্ত আয়াত আমাদের উপর নাযিল হাত, তাহ’লে আমরা ঐদিনটিকে ঈদের দিন হিসাবে গ্রহণ করতাম। তখন ওমর (রাঃ) বললেন,
আল্লাহর কসম! আমি জানি যেদিন এটি রাসূল (সাঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছিল এবং কখন এটি নাযিল হয়েছিল। এটি রাসূল (সাঃ)-এর উপর নাযিল হয়েছিল জুম’আ ও আরাফার দিন সন্ধ্যায়’ (আহমাদ হা/১৮৮, সনদ ছহীহ)। মুসলিমের বর্ণনায় জুম’আর রাতের  কথা বলা হয়েছে যার অর্থ ইমাম নববী বলেন, জুম’আর দিন (শরহ মুসলিম হা/ ৩০১৭)। বুখারীর বর্ণনায় স্পষ্টভাবে জুমআর দিনের (২ ) কথা বলা হয়েছে (বুখারী হা/৭২৬৮)।
অর্থাৎ জুমআর দিন মাগরিবের পূর্বে। কেননা মাওয়ার্দী বলেন, এ অর্থ অপরাহ্ন। যখন সূর্য অস্ত যাওয়ার জন্য ঢলে পড়ে। এ অর্থ সূর্যাস্তের পর অন্ধকার প্রকাশিত হওয়া’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা রূম ১৮ আয়াত)।
নববী বলেন, এর দ্বারা ওমর (রাঃ) বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, আমরা ঐদিনটিকে ঈদ হিসাবেই গ্রহণ করেছি। কেননা ঐদিন ছিল জুমআ এবং আরাফার দিন। আর দু’টিই হ’ল মুসলমানদের নিকট ঈদের দিন’ (শরহ মুসলিম হা/৩০১৭)। একই প্রশ্ন ইবনু আববাস (রাঃ)-কে করা হ’লে তিনি বলেন, এ ‘কেননা আয়াতটি নাযিল হয়েছিল ‘জুম’আ ও আরাফাহর দুই ঈদের দিন’ (তিরমিযী হা/৩০৪৪, সনদ ছহীহ)।
ইবনু জুরাইজ ও অন্যান্য বিদ্বানগণ বলেন, এই আয়াত নাযিলের পর আল্লাহর নবী (সাঃ) আর মাত্র ৮১ দিন ধরাধামে বেঁচে ছিলেন।
এই সময় একজন মুহরিম ব্যক্তি সওয়ারী থেকে পড়ে মারা গেলে রাসূল (সাঃ) তাকে কোনরূপ সুগন্ধি ছাড়াই পানি ও কুলপাতা দিয়ে গোসল দিয়ে ইহরামের দু’টি কাপড়েই কাফন দিতে বলেন। অতঃপর বলেন যেন তার মাথা ও চেহারা ঢাকা না হয় এবং খবর দেন যে, আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন তালবিয়া পাঠরত অবস্থায় উঠাবেন’।
মুযদালেফায় রাত্রি যাপন
অস্তায়মান সূর্যের হলুদ আভা মিলিয়ে যাবার পর উসামা বিন যায়েদকে ক্বাছওয়ার পিছনে বসিয়ে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুযদালেফা অভিমুখে রওয়ানা হন।অতঃপর সেখানে পৌঁছে এক আযান ও দুই এক্বামতের মাধ্যমে মাগরিব ও এশা পড়েন। এশার ছালাতে ক্বছর করেন। এদিন মাগরিবের ছালাত পিছিয়ে এশার ছালাতের সঙ্গে মিলিয়ে পড়া হয়। একে ‘জমা তাখীর’ বলা হয়। উভয়ের মাঝে কোন সুন্নাত-নফল পড়েননি। অতঃপর ফজর পর্যন্ত ঘুমিয়ে থাকেন। কোনরূপ রাত্রি জাগরণ করেননি। অতঃপর সকাল স্পষ্ট হ’লে তিনি আযান ও একামতের মাধ্যমে ফজরের ছালাত আদায় করেন। তিনি বলেন, মুযদালিফার পুরাটাই অবস্থানস্থল’ (ছহীহুল জামে’ হা/৪০০৬)। অতঃপর ক্বাছওয়ায় সওয়ার হয়ে মাশআরুল হারামে আসেন এবং ক্বিবলামুখী হয়ে দোআ ও তাসবীহ-তাহলীলে লিপ্ত হন। পূর্বাকাশ ভালভাবে ফর্সা না হওয়া পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করেন (মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭)।
এদিন তিনি দুর্বলদের ফজরের আগেই চাঁদ ডুবে যাবার পর মিনায় রওয়ানা হওয়ার অনুমতি দেন এবং নির্দেশ দেন যেন সূর্যোদয়ের পূর্বে কংকর নিক্ষেপ না করে। ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, এ ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে তিনটি মতামত রয়েছে। (১) সক্ষম বা দুর্বল যে কেউ মধ্যরাত্রির পরে যেতে পারবে (২) ফজর উদিত হওয়ার আগে রওয়ানা হওয়া যাবে না এবং (৩) দুর্বলরাই কেবল ফজর উদিত হওয়ার পূর্বে যেতে পারবে, সক্ষমরা নয়। এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত সেটাই, যা হাদীছে বর্ণিত হয়েছে যে, মধ্যরাত্রির পরে নয়, বরং চাঁদ ডুবে যাবার পর রওয়ানা হ’তে পারবে। মধ্যরাত্রির সীমা নির্ধারণ করার কোন দলীল নেই’ (যাদুল মা’আদ ২/২৩৩)।
মিনায় প্রত্যাবর্তন
অতঃপর সূর্যোদয়ের পূর্বেই তিনি মুযদালেফা হ’তে মিনায় রওয়ানা হন। এ সময় ফযল বিন আববাসকে কাছওয়া সওয়ারীর পিছনে বসিয়ে নেন। এ সময় তিনি তালবিয়াহ পাঠ করতে থাকেন। অতঃপর তিনি ইবনু আববাসকে সাতটি কংকর কুড়িয়ে দিতে বলেন। অতঃপর সেগুলি হাতে নিয়ে ঝেড়ে ফেলে বললেন, এরূপ কংকরই তোমরা নিক্ষেপ করবে। ধর্মের ব্যাপারে তোমরা বাড়াবাড়ি করো না। কেননা তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে ধ্বংস হয়েছে’। মিনায় আসার পথে ওয়াদীয়ে মুহাসসিরে  সামান্য দ্রুত চলেন। অতঃপর মধ্যবর্তী পথ ধরে জামরায়ে কুবরায় পৌঁছে যান, যেখানে একটি বৃক্ষ ছিল। অতঃপর সেখানে সওয়ারীতে বসে ৭টি কংকর নিক্ষেপ করেন। প্রতিটি কংকর নিক্ষেপের সময় আল্লাহু আকবর’ বলেন। কংকরগুলি ছিল এমন ছোট যা দু’আঙ্গুলে চিমটি দিয়ে ধরা যায়( এসময় তিনি তালবিয়াহ পাঠ বন্ধ রাখেন। বেলাল ও ওসামা দু’জনের একজন তাঁর উটনীর লাগাম ধরে রাখেন। অন্যজন কাপড় দিয়ে তাঁকে ছায়া করেন’। অতঃপর তারা কংকর নিক্ষেপ করেন।[3] এতে প্রমাণিত হয় যে, মুহরিম ব্যক্তি গরম থেকে বাঁচার জন্য মাথার উপর ছায়া করতে পারেন (যাদুল মা’আদ ২/২৩৭)।
কুরবানীর দিনের ভাষণ
১. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এদিন সূর্য ঢলার পর আযবা )  উটনীর পিঠে বসে কংকর নিক্ষেপ শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বলেন,
(১) হে জনগণ! তোমরা আমার নিকট থেকে হজ্জ ও কুরবানীর নিয়ম-কানুন শিখে নাও। হয়তবা এ বছরের পর আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না’। এভাবে বিদায় নেওয়ার কারণে লোকেরা একে হাজ্জাতুল বিদা বা বিদায় হজ্জ বলে (যাদুল মা’আদ ২/২৩৮)।
২. আবু বাকরাহ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি আরও বলেন,
(২) ‘কালচক্র আপন নিয়মে আবর্তিত হয়, যেদিন থেকে আসমান ও যমীন সৃষ্টি হয়েছে। বছর বারো মাসে হয়। তার মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস। তিনটি পরপর, যুলকাদাহ, যুলহিজ্জাহ ও মুহাররম এবং রজবে মুযার’যা হ’ল জুমাদা ও শা’বানের মধ্যবর্তী  অতঃপর তিনি বলেন, (৩) এটি কোন মাস? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, এটা কি যুলহিজ্জাহ নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, এটি কোন শহর? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, এটা কি মক্কা নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, আজ কোন দিন? আমরা বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত। অতঃপর তিনি চুপ থাকলেন। আমরা ভাবলাম হয়ত তিনি এর পরিবর্তে অন্য কোন নাম দিবেন। তিনি বললেন, আজ কি কুরবানীর দিন নয়? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, জেনে রেখ, তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ, তোমাদের ইয্যত তোমাদের উপরে ঐরূপ হারাম যেরূপ আজকের এই দিন, এই শহর, এই মাস তোমাদের জন্য হারাম (অর্থাৎ পরস্পরের জন্য উক্ত তিনটি বস্তু সর্বদা হারাম)। (৪) ‘সত্বর তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে মিলিত হবে। অতঃপর তিনি তোমাদের আমল সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। সাবধান!
আমার পরে তোমরা পুনরায় ‘পথভ্রষ্ট হয়ে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’। (৫) ‘হে জনগণ! আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিয়েছি (দু’বার)? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। রাসূল (সাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক! আর তোমাদের উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতগণকে কথাগুলি পৌঁছে দেয়। কেননা উপস্থিত শ্রোতাদের অনেকের চাইতে অনুপস্থিত যাদের নিকট এগুলি পৌঁছানো হবে, তাদের মধ্যে অধিক জ্ঞানী ব্যক্তি থাকতে পারেন’।
একই রাবীর অন্য বর্ণনায় এসেছে, সাবধান! আমার পরে তোমরা পুনরায় ‘কাফের’ হয়ে ফিরে যেয়ো না এবং একে অপরের গর্দান মেরো না’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটি ছিল উম্মতের জন্য তাঁর অছিয়ত স্বরূপ (বুখারী হা/১৭৩৯)।
এই ‘কাফের’ অর্থ কর্মগত কাফের অর্থাৎ অবাধ্য। আক্বীদাগত কাফের নয়, যা মুসলমানকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন, “তোমরা কি কিতাবের কিছু অংশের উপর ঈমান আনবে ও কিছু অংশে কুফরী করবে’? রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেকী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’ (বুখারী হা/৪৮)। এসময় তাঁকে কংকর নিক্ষেপ, কুরবানী ও মাথা মুন্ডনে আগপিছ হয়ে গেলে করণীয় কি হবে জিজ্ঞেস করা হ’লে তিনি বলেন, করে যাও। কোন সমস্যা নেই’ (মুসলিম হা/১৩০৬)।
৩. আবু উমামাহ বাহেলী (রাঃ) বলেন, এদিন আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি,
(৬) ‘হে জনগণ! শুনে রাখ আমার পরে কোন নবী নেই এবং তোমাদের পরে কোন উম্মত নেই। অতএব (৭) তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ইবাদত কর। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর। রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর। সন্তুষ্ট চিত্তে মালের যাকাত দাও। তোমাদের শাসকদের আনুগত্য কর। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ করা। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় কর। পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত আদায় কর। রামাযান মাসের ছিয়াম পালন কর। তোমাদের মালের যাকাত দাও। তোমাদের আমীরের আনুগত্য কর। তোমাদের প্রতিপালকের জান্নাতে প্রবেশ কর’।
মাথা মুন্ডন
কুরবানী শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাপিত ডাকেন এবং নিজের মাথা মুন্ডন করেন (মুসলিম হা/১৩০৪)। তাঁর ছাহাবীগণের অনেকে মুন্ডন করেন ও কেউ কেউ চুল ছাটেন। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, অতঃপর মাথার ডান পাশের চুলগুলি নাপিত মামার বিন আব্দুল্লাহকে দেন এবং বামপাশের চুলগুলি আবু ত্বালহা আনছারীকে দেন এবং বলেন, এগুলি লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দাও (মুসলিম হা/১৩০৫)। অতঃপর তিনি মাথা মুন্ডনকারীদের জন্য তিনবার ও চুল ছাটাইকারীদের জন্য একবার ক্ষমা প্রার্থনা করেন। পবিত্র কুরআনেও মাথা মুন্ডনের কথা আগে অতঃপর চুল ছাটাইয়ের কথা এসেছে (সূরা ফাতহ ৪৮/২৭)। এর ফলে অধিকাংশ মাথা মুন্ডন করেন ও কিছু ব্যক্তি চুল ছাটাই করেন (যাদুল মা’আদ ২/২৪৯)। নববী বলেন, কাটা চুল বণ্টনের মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর চুলের বরকত প্রমাণিত হয় এবং নেতা ও গুরুজনদের জন্য অধঃস্তনদের প্রতি হাদিয়া প্রদানের নির্দেশনা পাওয়া যায়।
১০ই যিলহজ্জ কুরবানীর দিন সকালে সূর্য উপরে উঠলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি সাদা-কালো মিশ্রিত খচ্চরে সওয়ার হয়ে (কংকর নিক্ষেপের পর) জামরায়ে আকাবায় এক ভাষণ দেন। এমতাবস্থায় লোকদের কেউ দাঁড়িয়েছিল, কেউ বসেছিল। হযরত আলী (রাঃ) তাঁর ভাষণ লোকদের শুনাচ্ছিলেন। এ দিনের ভাষণে তিনি আগের দিন আরাফাতের ময়দানে দেওয়া ভাষণের কিছু কিছু অংশ পুনরুল্লেখ করেন।
নবী জীবনের শেষ অধ্যায়
হজ্জ থেকে ফিরে যিলহজ্জের বাকী দিনগুলিসহ ১১ হিজরীর মুহাররম ও ছফর পুরা দু’মাস রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় অবস্থান করেন।
বিদায় হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার বিখ্যাত আয়াতটি (মায়েদাহ ৫/৩) নাযিল হয়। যা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর ৮১ দিন পূর্বের ঘটনা। ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন, অতঃপর আইয়ামে তাশরীকের মধ্যবর্তী দিনে মিনায় সূরা নছর’ নাযিল হয়। মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় কালালাহর বিখ্যাত আয়াতটি (নিসা ৪/১৭৬)। অতঃপর মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবার সর্বশেষ দু’টি আয়াত
নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট যার উপরে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু। ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও যে, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। তিনি মহান আরশের অধিপতি’ (তওবা ৯/১২৮-১২৯)। অতঃপর মৃত্যুর ২১ দিন মতান্তরে ৭ দিন পূর্বে নাযিল হয় কুরআনের সর্বশেষ আয়াতটি
“আর তোমরা ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন তোমরা পুনরায় ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১; কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।
জীবনের শেষ সপ্তাহ
রাসূল (সাঃ)-এর শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হ’তে থাকে। এ সময় তিনি বারবার স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতে থাকেন, আগামীকাল আমি কোথায় থাকব? আগামীকাল আমি কোথায় থাকব’? তারা এর অর্থ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি যেখানে খুশী থাকতে পারেন’। তখন তিনি আয়েশার গৃহে গমন করেন। এ সময় তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। ফল বিন আববাস ও আলী ইবনু আবী তালেবের কাঁধে ভর করে অতি কষ্টে তিনি পা টিপে টিপে হাঁটছিলেন । অতঃপর তিনি আয়েশার কক্ষে প্রবেশ করেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহটি সেখানেই অতিবাহিত করেন।
অন্য সময় আয়েশা (রাঃ) সূরা ফালাক ও নাস এবং অন্যান্য দো’আ, যা তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে শিখেছিলেন, সেগুলি পাঠ করে ফুঁক দিয়ে বরকতের আশায় রাসূল (সাঃ)-এর হাত তাঁর দেহে বুলিয়ে দিতেন। এ সময় তিনি সেটাই করতে চাইলেন। কিন্তু নিজের হাত টেনে নিয়ে রাসূল (সাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে দয়া কর এবং আমাকে সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত করা (বুখারী হা/৫৬৭৪)।
মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে
জীবনের শেষ বুধবার। এদিন তাঁর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় তিনি ঘরের মধ্যে মিসরীয় খ্রিষ্টান দাসী মারিয়া কিবত্বিয়াহ এবং হিজরতে থাকা অবস্থায় স্ত্রী উম্মে সালামাহ ও উম্মে হাবীবাহ হাবশাতে তাদের দেখা খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের কবর সমূহে তাদের প্রতিকৃতি আঁকিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে আলোচনা করলে রাসূল (সাঃ) মুখের চাদর ফেলে দিয়ে মাথা উঁচু ا ওদের মধ্যে কোন নেককার মানুষ মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো এবং তার মধ্যে তাদের ছবি আঁকতো। ওরা হ’ল কিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে সৃষ্টিজগতের নিকৃষ্টতম জীব। আল্লাহ ইহুদী-নাছারাদের উপরে লা’নত করুন! তারা তাদের নবীগণের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’ ।
সুলায়মান বিন ইয়াসার ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি আরও বলেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ো না, যাকে পূজা করা হয়। ঐ কওমের উপরে আল্লাহর প্রচন্ড ক্রোধ রয়েছে, যারা নবীগণের কবরসমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করে’।কা’ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি। দেখো, আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছে দিলাম (৩ বার)? হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’ (৩ বার)।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে তিনি বলেন, ‘তোমরা বিভিন্ন কূয়া থেকে পানি এনে আমার উপরে সাত মশক পানি ঢাল। যাতে আমি বাইরে যেতে পারি এবং লোকদের উপদেশ দিতে পারি। অতঃপর আমরা তাঁকে হাফছা বিনতে ওমরের পাথর অথবা তাম্র নির্মিত একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে দিলাম এবং তাঁর উপরে পানি ঢালতে লাগলাম। এক পর্যায়ে তিনি বলতে থাকেন, এটা ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও। অতঃপর একটু হালকা বোধ করলে তিনি মাথায় কাপড় দিয়ে যোহরের প্রাক্কালে মসজিদে প্রবেশ করেন। অতঃপর ছালাত আদায় করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন’।
এদিন বের হবার মূল কারণ ছিল আনছারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, আবুবকর ও আববাস (রাঃ) আনছারদের এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁরা তাদেরকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন যে, আমরা আমাদের সঙ্গে রাসূল (সাঃ) এর উঠাবসার কথা স্মরণ করছিলাম। অতঃপর তাঁদের একজন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে গিয়ে আনছারদের এই অভিব্যক্তির কথা অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে চাদরের এক প্রান্ত মাথায় বাঁধা অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ও মিম্বরে আরোহন করেন। এদিনের পর তিনি আর মিম্বরে আরোহন করেননি’। অতঃপর সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
(১) আমি তোমাদেরকে আনছারদের বিষয়ে অছিয়ত করে যাচ্ছি। তারা আমার বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্য বাকী রয়েছে। অতএব তোমরা তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করো এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে দিয়ো’  অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘মানুষ ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু আনছারদের সংখ্যা কমতে থাকবে। এমনকি তাদের অবস্থা হবে খাদ্যের মধ্যে লবনের ন্যায় অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কারু ক্ষতি বা উপকার করার মালিক হবে (অর্থাৎ নেতৃত্বে আসবে), সে যেন তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করে এবং মন্দগুলি ক্ষমা করো।
(২) জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে বলতে শুনেছি,
আমি আল্লাহর নিকট দায়মুক্ত এজন্য যে, তিনি আমাকে তোমাদের মধ্যে কাউকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দেননি। কেননা আল্লাহ আমাকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি ইবরাহীমকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে যদি আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবুবকরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তিনি আমার ভাই ও সাথী। লোকদের মধ্যে নিজের সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন আবুবকর। মনে রেখ, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছিল। তোমরা যেন এরূপ করো না’। আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’।
(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এদিন তিনি মিম্বরে বসে আরও বলেন, ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, সে চাইলে দুনিয়ার জাঁকজমক সবকিছু তাকে দেওয়া হবে অথবা আল্লাহর নিকটে যা আছে তা সে গ্রহণ করবে। অতঃপর সে বান্দা সেটাকেই পসন্দ করেছে, যা আল্লাহর নিকটে রয়েছে’। একথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) কেঁদে উঠে বললেন, আমাদের পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌন’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, আমাদের জীবন ও সম্পদ সমূহ’  রাবী বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই শায়খ কাঁদছেন কেন? এতে কাঁদবার কি আছে? বস্তুতঃ আবুবকর ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি’। অতঃপর তিনি বললেন, ‘হে আবুবকর! তুমি কেঁদো না। নিশ্চয় লোকদের মধ্যে সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ করেছেন আবুবকর। যদি আমি উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবুবকরকেই করতাম। কিন্তু ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসাই উত্তম। আর মসজিদের সকল দরজা বন্ধ হবে কেবল আবুবকরের দরজা ব্যতীত’।
মৃত্যুর চার দিন পূর্বে শেষ বৃহস্পতিবার
বৃহস্পতিবার রাসূল (সাঃ)-এর রোগযন্ত্রণা বেড়ে যায়। পরে যন্ত্রণা খুব বৃদ্ধি পেলে রাসূল (ছাঃ) বলে ওঠেন, কাগজ-কলম নিয়ে এসো! আমি তোমাদের জন্য লিখে দিয়ে যাই। যাতে তোমরা পরে পথভ্রষ্ট না হও’। উপস্থিত লোকদের মধ্যে ওমর (রাঃ) বললেন “তাঁর উপরে এখন রোগ যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। তোমাদের নিকটে কুরআন রয়েছে। আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট। এতে গৃহবাসীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ কাগজ-কলম আনতে চান। কেউ নিষেধ করেন। ফলে এক পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) বললেন, ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও’।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মৃত্যুকালীন রোগশয্যায় আমাকে বললেন, এই এই বার সভা , ‘তোমার পিতা আবুবকর ও তোমার ভাই (আব্দুর রহমান)-কে আমার কাছে ডেকে আন। আমি তাদেরকে একটি কাগজ লিখে দেব। কেননা আমি ভয় পাচ্ছি যে, কোন উচ্চাভিলাষী (খেলাফতের) উচ্চাকাংখা পোষণ করতে পারে এবং কোন ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে, আমিই এর অধিক হকদার । অথচ আল্লাহ ও মুমিনগণ আবুবকর ব্যতীত অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে’।
এতে বুঝা যায় যে, খিলাফত লিখে দিলে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর নামেই লিখতেন। আয়েশা (রাঃ)-এর বাধার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। অথচ আলী (রাঃ) প্রথম খলীফা না হওয়ার জন্য শী আরা অন্যায়ভাবে তাঁকেই দায়ী করে থাকে।
তিনটি অছিয়ত
অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সবাইকে তিনটি অছিয়ত করেন।
(১) ইহুদী, নাছারা ও মুশরিকদের আরব উপদ্বীপ থেকে বের করে দিয়ো৷
(২) প্রতিনিধিদলের সম্মান ও আপ্যায়ন অনুরূপভাবে করো, যেভাবে আমি করতাম।
(৩) তৃতীয় অছিয়তটির কথা রাবী সুলায়মান আল-আহওয়ালের বর্ণনায় আসেনি’ (বুখারী হা/৩১৬৮)। তবে ছহীহ বুখারীর ‘অছিয়ত সমূহ’ অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন আবু আওফা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, সেটি ছিল আল্লাহর কিতাবকে অাঁকড়ে ধরো’ (বুখারী হা/২৭৪০)।
সর্বশেষ ইমামতি
মৃত্যুর চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবার মাগরিবের ছালাতের ইমামতিই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ ইমামতি। অসুখ সত্ত্বেও তিনি এযাবত প্রতি ওয়াক্ত ছালাতে ইমামতি করেছেন। সর্বশেষ এই ইমামতিতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রথম দু’রাক’আতে সূরা মুরসালাত পাঠ করেন’। যার সর্বশেষ আয়াত ছিল এর পরে কোন্ বাণীর উপরে তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে? (মুরসালাত ৭৭/৫০)। অর্থাৎ কুরআনের পরে আর কোন্ কালামের উপরে তোমরা ঈমান আনবে?
এর দ্বারা যেন তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, আল্লাহ পাকের আহবানের সাথে সাথে উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি আমার জীবনের সর্বশেষ আহবান হ’ল, সর্বাবস্থায় তোমরা কুরআনের বিধান মেনে চলবে। কোন অবস্থাতেই কুরআন ছেড়ে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না।
মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে সর্বশেষ সামরিক অভিযান প্রেরণ
শনিবারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কিছুটা হালকা বোধ করেন। এমতাবস্থায় তিনি দু’জনের কাঁধে ভর করে মসজিদে আগমন করেন। তখন আবুবকর (রাঃ)-এর ইমামতিতে যোহরের জামা’আত শুরু হয়েছিল। রাসূল (সাঃ)-এর আগমন টের পেয়ে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসার উদ্যোগ নিতেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-কে আবুবকর (রাঃ)-এর বামপাশে বসিয়ে দেওয়া হ’ল। তিনি তখন রাসূল (সাঃ)-এর ইকতেদা করতে থাকেন এবং লোকদেরকে তাকবীর শুনাতে থাকেন’। বস্তুতঃ এটাই ছিল ছালাতে মুকাবিবর হওয়ার প্রথম ঘটনা। আর আবুবকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ‘মুকাবিবর’।
তাছাড়া এদিন তিনি উসামাহ বিন যায়েদ-এর নেতৃত্বে শাম অঞ্চলে সর্বশেষ সেনাদল প্রেরণ করেন (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ৯০)।
মৃত্যুর একদিন পূর্বে
সম্ভবতঃ মৃত্যুর পূর্বদিন রবিবার তিনি স্ত্রী আয়েশাকে বলেন, দীনারগুলি কি বিতরণ করেছ? তিনি বললেন, আপনার রোগ যন্ত্রণায় ব্যস্ত থাকার কারণে বিতরণের সময় পাইনি। রাসূল (সাঃ) বললেন, ওগুলি আমার কাছে নিয়ে এস। ঐ সময় ঘরে ৫ থেকে ৯টি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। আয়েশা (রাঃ) সেগুলি এনে তাঁর হাতে দিলেন। তখন তিনি বললেন, এগুলি এখুনি বিতরণ করে দাও। কেননা কোন নবীর জন্য এটি মর্যাদাকর নয় যে, এইরূপ (নিকৃষ্ট) বস্তুগুলি নিয়ে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবেন’। অথচ ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহুদীর নিকটে ৩০ ছা (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।
জীবনের শেষ দিন
সোমবার ফজরের জামা’আত চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ঘরের পর্দা উঠিয়ে একদৃষ্টে মসজিদে জামাআতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে তাঁর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ঠোটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। রাসূল (ছাঃ)-এর জামা’আতে আসার আগ্রহ বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসতে চান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দেন এবং দরজার পর্দা ঝুলিয়ে দেন। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর ভাষায় ‘ঐ সময় রাসূল (ছাঃ)-এর চেহারা ছিল যেন কুরআনের পাতা’ অতঃপর এদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন’।
কুরআনের বাস্তব রূপকার, মৃত্যুপথযাত্রী রাসূল (সাঃ) -এর শুচিশুদ্ধ আলোকময় চেহারা যেন পরম পবিত্র সত্যসন্ধ কুরআনের কনকোজ্জ্বল পৃষ্ঠার ন্যায় দীপ্ত ও জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছিল। আনাস (রাঃ)-এর এই অপূর্ব তুলনা সত্যি কতই না সুন্দর ও কতই না মনোহর! ছালাতের পাগল রাসূল (সাঃ)-এর ভাগ্যে যোহরের ওয়াক্ত আসার সুযোগ আর হয়নি।….
এরপর সূর্য কিছুটা উপরে উঠলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাকে কাছে ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে তাকে আবার ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি হেসে ওঠেন। প্রথমবারে রাসূল (সাঃ) তাকে বলেন যে, এই অসুখেই আমার মৃত্যু ঘটবে। তাতে তিনি কাঁদেন। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেন যে, পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে (অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হবে)। তাতে তিনি হাসেন। এই সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে “জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী। হবার সুসংবাদ দান করেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর রোগ-যন্ত্রণার কষ্ট দেখে ফাতেমা (রাঃ) বলে ওঠেন, ‘হায় কষ্ট’! রাসূল (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, আজকের দিনের পর তোমার পিতার আর কোন কষ্ট নেই’।
অতঃপর তিনি হাসান ও হোসায়েনকে ডাকেন। তাদেরকে আদর করে চুমু দেন ও তাদেরকে সদুপদেশ দেন। উভয়ের বয়স তখন যথাক্রমে ৮ ও ৭ বছর। এরপর স্ত্রীগণকে ডাকেন ও তাদেরকে বিভিন্ন উপদেশ দেন। এ সময় তাঁর রোগ-যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে আয়েশা! খায়বরে যে বিষমিশ্রিত খাদ্য আমি খেয়েছিলাম, সে বিষের প্রভাবে আমার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে’। তিনি গিলেননি, ফেলে দিয়েছিলেন। তাতেই যে সামান্য বিষক্রিয়া হয়, সেটিই মৃত্যুকালে তাঁকে কঠিনভাবে কষ্ট দেয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে, পুরানো কোন অসুখ যা সুপ্ত থাকে, তা বার্ধক্যে বা মৃত্যুকালে মাথা চাড়া দেয়।
উল্লেখ্য যে, ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয় শেষে ইহুদী বনু নাযীর গোত্রের নেতা সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাঁকে দাওয়াত দিয়ে বিষমিশ্রিত বকরীর ভুনা রান খেতে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই গোশত মুখে দিয়ে চিবানোর পর না গিলে ফেলে দেন  এবং বলেন, এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে এতে বিষ মিশানো আছে’। অতঃপর তিনি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ছালাত ছালাত এবং তোমাদের দাস-দাসী’ অর্থাৎ ছালাত ও স্ত্রীজাতির বিষয়ে তোমরা সর্বাধিক খেয়াল রেখো’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একথাটি তিনি বারবার পুনরাবৃত্তি করেন’। আনাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ অছিয়ত’।
মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু
এরপর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হ’ল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্ত্রী আয়েশার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় আয়েশা (রাঃ)-এর ভাই আব্দুর রহমান (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসূল (সাঃ) এর দৃষ্টি গেল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁর অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাঁকে দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলি সহ) মুখ ধৌত করলেন। এসময় তিনি বলতে থাকেন, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা সমূহ। এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙ্গুল উচিয়ে বলতে থাকলেন,
“(হে আল্লাহ!) নবীগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককার ব্যক্তিগণ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর। হে আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আয়েশা (রাঃ) বলেন, শেষের কথাটি তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল’। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হ’লেন। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার ঘরে, আমার পালার দিন এবং আমার বুক ও গলার মধ্যে হেলান দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে পার্থিব জীবনের শেষ দিন ও পরকালীন জীবনের প্রথম দিন আল্লাহ আমার মুখের লালার সাথে তাঁর মুখের লালা মিলিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ঘরেই তাঁর দাফন হয়েছে’।
আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন তাঁর মাথা ছিল আমার রানের উপর, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি ছাদের দিকে চক্ষু নিবন্ধ করলেন। অতঃপর বললেন, ‘হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ বন্ধু’। আর এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এর দ্বারা আমি বুঝলাম, এখন তিনি আর আমাদের পসন্দ করবেন না। বুঝলাম, যে কথা তিনি সুস্থ অবস্থায় বলতেন, সেটাই ঠিক হ’ল। তা এই যে, ‘কোন নবী মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না জান্নাতে তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়। অতঃপর তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুবরণ করে জান্নাতে যাওয়ার’। আমি বুঝলাম যে, তিনি আখেরাতকেই পসন্দ করলেন।অতঃপর আমি তাঁর মাথা বালিশে রাখি এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসি’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন (আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী; (বাকারাহ ২/১৫৬)।
উপরোক্ত দুই বর্ণনার সমন্বয় এটাই হাতে পারে যে, বুকের উপরে মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হ’লে তিনি তাঁকে স্বীয় রানের উপরে শুইয়ে দেন এবং তখনই রাসূল (ছাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দিনটি ছিল সোমবার (বুখারী হা/১৩৮৭) সূর্য অধিক গরম হওয়ার সময় (alal Ja) অর্থাৎ ১০/১১ টার সময়। এ দিন তাঁর বয়স হয়েছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৬৩ বছর (বুখারী হা/৩৫৩৬) [5] চার দিন (রহমাতুল্লিল আলামীন ১/২৫১)।
মৃত্যুতে শোকাবহ প্রতিক্রিয়া
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুতে শোকাতুর কন্যা ফাতেমা বলে ওঠেন,
“হায় আববা! যিনি প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আববা! জান্নাতুল ফেরদৌসে যার ঠিকানা। হায় আববা! জিব্রীলকে আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছি’। অতঃপর দাফন হয়ে গেলে তিনি বলেন, হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর মাটি ফেলে তোমাদের অন্তর কি খুশী হয়েছে’?
সাধারণভাবে ছাহাবীগণের অবস্থা ছিল এই যে, তাঁরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সাঃ)-এর বিয়োগব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না। অনেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। অনেকে জঙ্গলে চলে যান। ওমর ফারূক (রাঃ) হতবুদ্ধি হয়ে বলতে থাকেন, কিছু মুনাফিক লোক ধারণা করে যে, রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে। অথচ নিশ্চয়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। বরং স্বীয় প্রতিপালকের নিকটে গমন করেছেন। যেমন মূসা (আঃ) নিজ সম্প্রদায় থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে এসেছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। তিনি বলেন, অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে দিবেন। অতঃপর তিনি ঐসব লোকদের হাত-পা কেটে দিবেন’ (বুখারী হা/৩৬৬৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, ‘আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মরেননি এবং মরবেনও না, যতক্ষণ না তিনি মুনাফিকদের বহু লোকের হাত-পা কেটে দেন’ (ইবনু মাজাহ হা/১৬২৭, হাদীছ ছহীহ)।
গোসল ও কাফন
সোমবার দিনভর রাসূল (ছাঃ)-এর স্থলাভিষিক্ত নেতা বা খলীফা’ নির্বাচনে ব্যয় হয়ে যায়। ছাক্কীফায়ে বনী সা‘এদায় সর্বসম্মতভাবে হযরত আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ) উম্মতের খলীফা নির্বাচিত হন। পরদিন মঙ্গলবার সকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গোসল দেওয়া হয়। এই সময় পর্যন্ত রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ মুবারক একটি জরিদার ইয়ামনী চাদর দ্বারা আবৃত রাখা হয় এবং তাঁর কক্ষ ভিতর থেকে তাঁর পরিবারের সদস্যগণ বন্ধ করে রাখেন।
গোসলের কাজে অংশ নেন রাসূল (ছাঃ)-এর চাচা হযরত আববাস ও তাঁর দুই পুত্র ফযল ও কুছাম  এবং রাসূল (সাঃ)-এর মুক্তদাস শুক্করান উসামা বিন যায়েদ ও আওস বিন খাওলী এবং হযরত আলী (রাঃ) সহ মোট ৭জন। আওস ছিলেন খাযরাজ গোত্রের একজন বদরী ছাহাবী। যিনি হযরত আলীকে আল্লাহর কসম দিয়ে গোসলের কাজে শরীক হওয়ার অনুমতি চেয়েছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬২)। আওস বিন খাওলী রাসূল (সাঃ)-এর দেহ মুবারক নিজের বুকের উপরে ঠেস দিয়ে রাখেন। হযরত আববাস ও তাঁর পুত্রদ্বয় তাঁর দেহের পার্শ্ব পরিবর্তন করে দেন। উসামা ও শুকরান পানি ঢালেন এবং হযরত আলী রাসূল (ছাঃ)-এর দেহ মুবারক ধৌত করেন। এসময় রাসূল (সাঃ)-এর পরিহিত পোষাক খোলা হয়নি।
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ)-কে তিনটি ইয়ামনী সাদা চাদর দিয়ে কাফন পরানো হয়। এগুলির মধ্যে স্বামীছ ও পাগড়ী ছিল না। তাঁর অন্য বর্ণনায় এসেছে, লোকেরা তাঁকে গোসল দেওয়ার সময় মতভেদ করল যে, অন্যান্য মাইয়েতের দেহ থেকে যেভাবে কাপড় খুলে নেওয়া হয়, সেভাবে করা হবে কি-না? তখন আল্লাহ তাদের উপর নিদ্রা চাপিয়ে দেন। যাতে তারা সবাই ঢুলতে থাকে। এরি মধ্যে হঠাৎ একজন গৃহ কোণ থেকে বলে উঠে, “তোমরা নবীকে গোসল দাও তাঁর দেহের কাপড় সহ। তখন সকলে উঠে দাঁড়াল এবং তাঁকে গোসল দিল। এমতাবস্থায় তাঁর দেহে স্বামীছ (জামা) ছিল। স্বামীছের উপর দিয়েই তারা পানি ঢালে এবং স্বামীছের উপর দিয়েই তাঁর দেহ কচলায়’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, ‘যদি আমি আগে জানতাম যা পরে জানলাম, তাহ’লে রাসূল (সাঃ)-কে কেউই গোসল দিতে পারত না, তাঁর স্ত্রীগণ ব্যতীত’। এক্ষণে তাঁকে পরিহিত পোষাকসহ গোসল ও কাফন করা হয় বিধায় প্রথম বর্ণনায় কাফনের কাপড়ের মধ্যে স্বামীছ বা জামা ছিল না বলার সেটিও একটি কারণ হ’তে পারে।
তিনটি কাপড়ে কাফন দেওয়ার কথা বিভিন্ন ছহীহ হাদীছে এসেছে। কিন্তু তিনটি কাপড়ের ব্যাখ্যা এসেছে আহমাদ (হা/১৯৪২), আবুদাউদ হা/৩১৫৩), তিরমিযী (হা/৯৯৭) সহ অন্যান্য হাদীছে কামীছ, ইযার ও লিফাফাহ তথা জামা, লুঙ্গী ও বড় চাদর হিসাবে। যদিও ঐসব হাদীছগুলির সনদ দুর্বলতা মুক্ত নয়। তবে জামা সহ তিন কাপড়ে কাফন দেওয়া জায়েয হওয়ার ব্যাপারে বিদ্বানগণের মধ্যে কোন মতভেদ নেই’।
জানাযা
ঘরের মধ্যে খননকৃত কবরের পাশেই লাশ রাখা হয়। অতঃপর আবুবকর (রাঃ)-এর নির্দেশক্রমে দশ দশজন করে ভিতরে গিয়ে জানাযা পড়েন। জানাযায় কোন ইমাম ছিল না। প্রথমে রাসূল (সাঃ)-এর পরিবার-পরিজন, অতঃপর মুহাজিরগণ, অতঃপর আনছারগণ জানাযার ছালাত আদায় করেন। এভাবে পুরুষ, মহিলা ও বালকগণ পরপর জানাযা পড়েন। জানাযার এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া মঙ্গলবার সারা দিন ও রাত পর্যন্ত জারী থাকে। ফলে বুধবারের মধ্যরাতে দাফনকার্য সম্পন্ন হয় (ইবনু হিশাম ২/৬৬৪)। মানছুরপুরী বলেন, ইসলামী ক্যালেন্ডার অনুযায়ী সন্ধ্যার পরেই দিন শেষ হয়ে যায় এবং পরবর্তী দিন শুরু হয়। সেকারণ মঙ্গলবার ও বুধবারের মতভেদ দূর করার জন্য আমরা ঘণ্টার আশ্রয় নিয়েছি। সে হিসাবে মৃত্যুর প্রায় ৩২ ঘণ্টা পরে রাসূল (সাঃ)-এর দাফন কার্য সম্পন্ন হয়। এভাবেই ৬৩ বছরের পবিত্র জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
দাফন
দাফন কোথায় হবে এ নিয়ে মতভেদ সৃষ্টি হয়। তখন আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) এসে বলেন, “আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে, নবীগণ যেখানে মৃত্যুবরণ করেন, সেখানেই কবরস্থ হন’। এ হাদীছ শোনার পর সকল মতভেদের অবসান হয়। ছাহাবী আবু ত্বালহা রাসূল (সাঃ)-এর বিছানা উঠিয়ে নেন। অতঃপর সেখানেই ‘লাহাদ’ )  অর্থাৎ পাশখুলী কবর খনন করা হয়’ (ইবনু মাজাহ হা/১৫৫৭)। আবু ত্বালহা উক্ত কবর খনন করেন (ইবনু হিশাম ২/৬৬৩)। অতঃপর কবরে নামেন হযরত আলী, ফযল ও কুছাম বিন আববাস, শুকরান ও আউস বিন খাওলী’ (ইবনু হিশাম ২/৬৬৪)।
নবী পরিবার
রাসূল পরিবার’ বলতে তাঁর স্ত্রীগণ এবং আলী, ফাতেমা, হাসান ও হোসাইনকে বুঝানো হয়’ (মুসলিম হা/২৪২৪)। যারা ছিলেন উম্মতের সবচেয়ে মর্যাদাবান পরিবার। আল্লাহ বলেন, ‘হে নবী পরিবারের সদস্যগণ! আল্লাহ চান তোমাদের থেকে অপবিত্রতা দূর করতে এবং তোমাদেরকে পূর্ণরূপে পূত-পবিত্র রাখতে’ (আহযাব ৩৩/৩৩)। তবে অন্য এক বর্ণনায় ‘আহলে বায়েত’ বলতে তাদেরকে বুঝানো হয়েছে, যাদের উপর চিরদিন ছাদাক্বা গ্রহণ করা নিষিদ্ধ। তাঁরা হ’লেন, আলী, ‘আক্বীল, জা’ফর ও আববাস (রাঃ)-এর বংশধরগণ’ (মুসলিম হা/ ২৪০৮, ‘আলীর মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ)। ইবনু কাছীর বলেন, ‘আহলে বায়েত’ বলতে কেবল নবীপত্নীগণ নন। বরং তাঁর পরিবারগণও এর অন্তর্ভুক্ত। আর এটিই এ বিষয়ে বর্ণিত কুরআন ও হাদীছসমূহকে শামিল করে (ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আহযাব ৩৩ আয়াত)। নিম্নে ‘রাসূল পরিবার’ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা পেশ করা হ’ল।
পরিত্যক্ত সম্পদ
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)  স্বীয় ওফাতের পর দীনার-দিরহাম, বকরী-উট কিছুই রেখে যাননি। তিনি কোন কিছুর অছিয়তও করে যাননি। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, (আমার মৃত্যুর পর) আমার ওয়ারিছগণ কোন দীনার ভাগ-বণ্টন করবে না। আমি যা রেখে যাব (অর্থাৎ বনু নাযীরের ফাই এবং খায়বরের ফাদাক খেজুর বাগান) স্ত্রীদের খোরপোষ এবং আমার ‘আমেল (কর্মচারী)-দের ব্যয় নির্বাহের পর তা সবই ছাদাক্বা হবে। উম্মুল মুমিনীন জুওয়াইরিয়া বিনতুল হারেছ-এর ভাই ‘আমর ইবনুল হারেছ (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) তাঁর মৃত্যুকালে কোন দীনার-দিরহাম, দাস-দাসী বা অন্য কিছুই ছেড়ে যাননি। কেবল তাঁর সাদা খচ্চর, অস্ত্র ও (ফাদাকের) জমিটুকু ব্যতীত। যা তিনি ছাদাক্বা করে যান।এর অর্থ হ’ল সংসারের ব্যয় নির্বাহের পর উদ্বৃত্তগুলি ছাদাক্বা হবে (ফাৎহুল বারী, ঐ)। আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, আমরা নবীগণ কোন ওয়ারিছ রেখে যাই না। যা কিছু আমরা ছেড়ে যাই, সবই (উম্মতের জন্য) ছাদাক্বা হয়ে যায়’।তাঁর মৃত্যুর পর ফাতেমা (রাঃ) ফাদাক-এর উত্তরাধিকার দাবী করলে অত্র হাদীছ শোনার পর তা প্রত্যাহার করে নেন। যদিও শী’আরা এজন্য আবুবকর (রাঃ)-কে দায়ী করে থাকে। অথচ আলী (রাঃ) খলীফা হওয়ার পরেও তিনি উক্ত দাবী করেননি।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *