‘কোনো মুরব্বির পরামর্শ ছাড়া নবীনদের ওয়াজের ময়দানে আসা উচিৎ নয়’

‘কোনো মুরব্বির পরামর্শ ছাড়া নবীনদের ওয়াজের ময়দানে আসা উচিৎ নয়’

উপমহাদেশের শত বছরের ঐতিহ্য ইসলামী জলসা বা ওয়াজ মাহফিল। প্রবীণদের পাশাপাশি বর্তমানে এ মাঠে নবীনরা বেশ এগিয়ে এসেছেন। তবে নবীনদের অভিজ্ঞতা, ইলম আর দক্ষতার কমতির কারণে তাদের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ এই মঞ্চে তৈরি হয় অপ্রত্যাশীত নানা ঘটনা। প্রশ্নবিদ্ধ হয় দ্বীন প্রচারের অন্যতম এই মাধ্যম।

নবীনরা এ ময়দানে আসার পর তাদের পথচলা কেমন হবে? কাদেরকে আইডল হিসেবে মেনে এগিয়ে চলবে তারা? উপমহাদেশে দ্বীন প্রচারের অন্যতম এই মাধ্যমকে কীভাবে আরো সমৃদ্ধ করা যায়? এসব নিয়ে কথা বলেছিলাম নন্দিত মুফাসসির, জনপ্রিয় ইসলামি আলোচক মাওলানা খুরশিদ আলম কাসেমীর সঙ্গে। নবীন ও তরুণদের জন্য বেশ উপকারী কিছু পরামর্শ উঠে এসেছে তার কথায়। আওয়ার ইসলাম পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরছি-

ওয়াজের ময়দান দ্বীন প্রচারের অন্যতম বড় একটি মাধ্যম। এখানে তরুণ আলেমদের উপস্থিতি দিন দিন বাড়ছে। বিষয়টিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

এটা পয়গাম্বরী যিম্মাদারী। অবশ্যই এটি ভালো কাজ। তরুণ ও নবীনদের আমি সাধুবাদ জানাই। তবে নিয়তে যদি গড়মিল থাকে তাহলে কিন্তু অনেক সমস্যা। আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বান করা এটা তো এ উম্মতের যিম্মাদারী। কিন্তু এই যিম্মাদারী পালন করতে গিয়ে অবশ্যই নিয়তটা সঠিক রাখতে হবে। আর এই নিয়ত ঠিক রাখতে হলে থাকতে হবে একজন মুরব্বি; যিনি তাকে পথচলার জন্য যাবতীয় বিষয়ে দিকনির্দেশনা প্রদান করবেন। তাই নবীন ও তরুণরা এই ময়দানে আসার আগে অবশ্যই কোনো মুরব্বির পরামর্শ নিয়ে আসতে হবে। না হয় তাদের পদস্থলের সম্ভাবনা থেকে যায়।

ওয়াজ-নসিহার ময়দানে আসার আগে নবীনদের পূর্ব প্রস্তুতি কেমন হওয়া উচিৎ?

তাদেরকে সাবধান থাকতে হবে কোনোভাবেই যেন এমন কোনো কথা মুখ থেকে বের না হয়, যা তাকে এবং ইসলামকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। তাই প্রতিটি আলোচনার আগে বিস্তর মোতালাআ করতে হবে। প্রবীণ আলোচকদের আলোচনা বেশি বেশি শুনতে হবে। আকাবিরদের জীবনী পড়তে হবে। চেষ্টা করতে হবে দলিলসহ তাহকীকী মুতালাআ করার। ভাসা ভাসা জ্ঞানে কোথায় আলোচনা করা থেকে সব সময় বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে তার একটি ভুল কথায় হাজার মানুষ ভুল পথে চলে যেতে পারে।

ওয়াজের মাঠে তরুণদের কী কী বিষয়ে সচেতনতা অবলম্বন করা উচিৎ?

বিতর্কিত কোনো বিষয় নিয়ে তরুণদের আলোচনা না করাই উত্তম। এসব নিয়ে আলোচনার জন্য মুরব্বিগণ আছেন। তাছাড়া মতের বিপরীত কাউকে সরাসরি আঘাত করে কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হবে। বিশেষ করে আহলে হাদিস ও বিদআতিদের বিষয়ে নবীনরা আলোচনা না করাই ভালো। তারা তাদের প্রতি সহনশীল দৃষ্টিভঙ্গিতে কথা বলবে। অযথা তর্কে জড়াবে না। তবে মাসআলায়ে খতমে নবুওয়তের বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। এ বিষয়ে বেশি বেশি মুতালাআ করতে হবে। মানুষকে শক্তভাবে সচেতন করতে হবে।

এছাড়া তরুণ ও নবীনদের বিষয়ে একটি অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়, তারা ঠিক মতো নামাজের পাবন্দি করে না। নিজেকে একজন আদর্শ ইসলামি আলোচক এবং ওয়ায়েজ হিসেবে গড়ে তুলতে চাইলে অবশ্যই নামাজের বিষয়ে সচেতন হতে হবে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সঙ্গে পড়তে হবে। পাশাপাশি আওয়াবিন, ইশরাক, তাহাজ্জুদও ছাড়া যাবে না। তাহলেই মানুষের মাঝে তার কথা প্রভাব পড়বে। মানুষ দ্বীনের পথে আসবে।

অপ্রত্যাশিতভাবে কখনো যদি কোনো পদস্খলন হয়ে যায়, তখন নবীনদের কী করা উচিৎ?

নবীনদের ভুল বেশি হয়। কারণ তারা এ ময়দানে নতুন। তাই আবারো বলছি, প্রতিটি আলোচনার আগে বিস্তর পড়াশোনা করে তারপর আলোচনা করতে হবে। এরপরও যদি অসাবধানতা বশত আলোচনায় কোনো ভুল কথা বলে ফেলে তাহলে ওই কথাটা উল্লেখ করে অন্য মাহফিলে নিজের ভুল স্বীকার করে নেবে। বলবে, “আমি অমুক জায়গায় এ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে এমন ভুল করেছি। এটি আমার উচিৎ হয়নি।’ তাছাড়া যে এলাকায় ভুলটি করেছে চেষ্টা করবে সেখানের আয়োজন কমিটির মাধ্যমে বিষয়টি এলাকায় ঘোষণা দেয়ার। আর আলোচনায় যদি নির্দিষ্টভাবে কারো বিরুদ্ধে ভুল কিছু বলা হয় তাহলে তার কাছে ফোনে বা অন্যকোনো উপায়ে ক্ষমা চেয়ে নেবে।

নবীনরা এ ময়দানে কাদেরকে আইডল হিসেবে নিতে পারে?

বড় আফসোস হয় ওয়াজের ময়দানের বর্তমান হালত দেখলে। এমনটি আমরা আশা করিনি। কারো কোনো মুরব্বি নাই। যাচ্ছেতাইভাবে নিজের মতো করে নিজেরা চলছে। তার এই ময়দানকে কলঙ্কিত করছে। তাই এই ময়দানে আসার আগে এমন একজন মুহাক্কিক আলোচককে আইডল বানাতে হবে; যিনি কোনো আহলুল্লাহর ‘খেলাফতপ্রাপ্ত”। তাছাড়া এমন ব্যক্তিকে আইডল বানাবে যিনি প্রতিটি বিষয়ে তার ভুল ধরিয়ে দিতে পারবে। এটা খুব জরুরী বিষয়।

ধরো তুমি আমাকে আইডল হিসেবে গ্রহণ করলে, কিন্তু আমি নিজেই সঠিক পথে নেই। তাহলে এমতাবস্থায় বলো, আমি তোমাকে কীভাবে সঠিক পথের কথা বলবো! বর্তমানে তো যেই আলোচক চিল্লিয়ে কথাবার্তা বলতে পারে, নবীনরা ধরে নেয়, এই বক্তাকেই আমার আইডল হওয়া উচিত’। অথচ এই বক্তার মাধ্যমে দিন। দিন ক্ষতি হচ্ছে।

একজন ওয়ায়েজের জন্য আহলে দিল ওয়ালার ‘নেসবত’ শর্ত। কারণ এটা এ জন্য জরুরি যে, ইদানিং কালের কিছু মৌলভী দু’চারটা কথা বলতে পারলেই নিজেকে অনেক কিছু ভাবতে শুরু করে। এটি কিবির, অহংকার। আর অহংকার পতনের মূল। তাছাড়া অনেকে নিজেকে ভাইরাল করার জন্য নিজেই ভিডিও ক্যামরা সঙ্গে নিয়ে ঘুরে। নবীনরা অবশ্যই এ থেকে বেঁচে থাকবে।

কারো যদি প্রসিদ্ধ হতে মনে চায়, তাকে নিরিবিলি কাজ করে যেতে হবে। ইনশাআল্লাহ এর প্রসিদ্ধি ধীরে ধীরে বাড়তে থাকবে এবং তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। ফলে তার কাজের মর্যাদা একসময় তাকে এতটা প্রসিদ্ধ ও মাকবুল করবে, যা কল্পনায়ও আসবে না। আর সেই প্রসিদ্ধি স্থায়ী হবে। এর পেছনে কোনো আলোচনা-সমালোচনা থাকবে না। আর ভিডিও, ফেসবুকের মাধ্যমে যে প্রসিদ্ধি অর্জন হয়, পরবর্তীতে এর দ্বারা সুনামের চেয়ে বদনাম-ই বেশি হয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *