দুনিয়া ও পরকালে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করবে যারা

দুনিয়া ও পরকালে ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করবে যারা

অশ্লীলতার শাস্তি ভয়াবহ। অশ্লীলতা বিপর্যয় ডেকে আনে। অশ্লীলতা শয়তানের কাজ। মানুষের ওপর শয়তানের প্রথম আক্রমণ ছিল কাপড় খসিয়ে তাকে উলঙ্গ করে দেওয়া। অশ্লীলতা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়। মানুষের আমল-আখলাক নষ্ট করে দেয়। দুনিয়া ও পরকালে তাদের জন্য রয়েছে ভয়াবহ শাস্তি। আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেন-

নিশ্চয়ই যারা এটা পছন্দ করে যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ুক, তাদের জন্য দুনিয়া ও আখেরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন এবং তোমরা জান না।’ (সুরা নুর: আয়াত ১৯)

আয়াতে فَاحِشَة শব্দের অর্থ হলো- নির্লজ্জতা, অশ্লীলতা। তবে কোরআনে ব্যভিচারকেও فَاحِشَة (অশ্লীলতা) বলে গণ্য করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা অশ্লীলতার পরিচয় এভাবে দিয়েছেন-

“তোমরা ব্যভিচারের কাছাকাছিও যেয়ো না, নিশ্চয়ই তা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ।’ (সুরা বনি ইসরাইল: আয়াত ৩২)

“তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ এ হুকুম ব্যক্তির জন্য এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র সমাজের জন্যও বটে। আয়াতে ব্যভিচার হারাম হওয়ার দুটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে-

এক. এটি একটি অশ্লীল কাজ। মানুষের মধ্যে লজ্জা-শরাম না থাকলে সে মনুষ্যত্ব থেকে বঞ্চিত হয়ে যায়। এরপর তার দৃষ্টিতে ভালমন্দের পার্থক্য লোপ পায়। কিন্তু যাদের মধ্যে মনুষ্যত্বের সামান্যতম অংশও থাকে, তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিলে তারা ব্যভিচারকে অন্যায় বলে স্বীকৃতি দিতে দ্বিধা করে না। হাদিসে পাকে এ রকম একটি ঘটনা ওঠে এসেছে-

হজরত আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, এক যুবক রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমাকে ব্যভিচার করার অনুমতি দিন। এটা শুনে চতুর্দিক থেকে লোকেরা তার দিকে তেড়ে এসে ধমক দিল এবং চুপ করতে বলল। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে কাছে ডেকে নিয়ে বললেন, বস। যুবকটি বসলে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, তুমি কি এটা তোমার মায়ের জন্য পছন্দ কর? যুবক উত্তর করলো- আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তেমনিভাবে মানুষও তাদের মায়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না।

তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তোমার মেয়ের জন্য তা (ব্যভিচার) পছন্দ কর? যুবক উত্তর করলো- আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ, তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, অনুরূপভাবে মানুষ তাদের মেয়েদের জন্য সেটা পছন্দ করে না।

তারপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি তোমার বোনের জন্য সেটা পছন্দ কর? যুবক উত্তর করলো- আল্লাহ আমাকে আপনার জন্য উৎসর্গ করুন, আল্লাহর শপথ! তা কখনো পছন্দ করি না। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তদ্রুপ লোকেরাও তাদের বোনের জন্য তা পছন্দ করে না। (এভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার ফুফু ও খালা সম্পর্কেও অনুরূপ কথা বললেন আর যুবকটি একই উত্তর দিল)

এরপর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার উপর হাত রাখলেন এবং বললেন, ‘হে আল্লাহ! তার গুনাহ ক্ষমা করে দিন, তার মনকে পবিত্র করুন এবং তার লজ্জাস্থানের হেফাজত করুন।’ বর্ণনাকারী সাহাবি বলেন, এরপর এ যুবককে কারো প্রতি তাকাতে দেখা যেত না। (মুসনাদে আহমাদ ৫/২৫৬, ২৫৭)

দুই. এটি সামাজিক অনাসৃষ্টি। ব্যভিচারের কারণে এটা এত প্রসার লাভ করে যে, এর কোনো সীমা-পরিসীমা থাকে না। এর অশুভ পরিণাম অনেক সময় সমগ্ৰ গোত্র ও সম্প্রদায়কে বরবাদ করে দেয়। এ কারণেই ইসলাম এ অপরাধটিকে সব অপরাধের চাইতে গুরুতর বলে সাব্যস্ত করেছে। এবং এর শাস্তি ও সব অপরাধের শাস্তির চাইতে কঠোর বিধান করেছেন। কেননা, এই একটি অপরাধ অন্যান্য শত শত অপরাধকে নিজের মধ্যে সন্নিবেশিত করেছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘ব্যভিচারি ব্যক্তি ব্যভিচার করার সময় মুমিন থাকে না। চোর চুরি করার সময় মুমিন থাকে না। মদ্যপায়ী মদ্যপান করার সময় মুমিন থাকে না। (মুসলিম ৫৭ )

ইসলামে ব্যভিচার যেহেতু বড়ই অপরাধমূলক কাজ; তাই এত বড় অপরাধ যে কোনো বিবাহিত পুরুষ অথবা নারীর দ্বারা হয়ে গেলে, ইসলামী সমাজে তার জীবিত থাকার অধিকার থাকে না। আবার তাকে তরবারির এক আঘাতে হত্যা করাও যথেষ্ট হয় না, বরং ইসলামের নির্দেশ হলো- পাথর মেরে মেরে তার জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটাতে হবে। যাতে সে সমাজে (অন্যদের জন্য) শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে যায়।

সেহেতু এখানে বলা হয়েছে, ‘ব্যভিচারের কাছেও যেয়ো না’ অর্থাৎ নির্দেশ হচ্ছে- তাতে উদ্বুদ্ধকারী উপায়- উপকরণ থেকেও দূরে থাকা। যেমন- ‘গায়ের মাহরাম’ (যার সঙ্গে বিয়ে হারাম নয় এমন বেগানা নারীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করা, তার সঙ্গে অবাধ মেলামেশার ও কথা বলার পথ সুগম করা। অনুরূপ নারীদের সাজ-সজ্জা করে বেপর্দার সঙ্গে বাড়ী থেকে বের হওয়া ইত্যাদি যাবতীয় কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকা জরুরি। যাতে এই ধরনের অশ্লীলতা থেকে বাঁচা যায়।

মিথ্যা খবর প্রচারও অশ্লীলতা

আবার ব্যভিচারের একটি মিথ্যা খবর প্রচার করাকেও আল্লাহ তাআলা অশ্লীলতা বলে অভিহিত করেছেন এবং একে দুনিয়া ও আখেরাতে কঠিন শাস্তির কারণ হিসাবে গণ্য করেছেন। যাতে অশ্লীলতা সম্পর্কে ইসলামের ভূমিকা এবং আল্লাহ তাআলার ইচ্ছার অনুমান করা যেতে পারে যে, কেবলমাত্র অশ্লীলতার একটি মিথ্যা খবর প্রচার করা আল্লাহর কাছে এত বড় অপরাধ, তাহলে যারা দিন-রাত মুসলিম সমাজে সংবাদপত্র, রেডিও, টিভি, ভিডিও, সিডি, ইন্টারনেট প্রভৃতির মাধ্যমে যেসব অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে ও ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে, তারা আল্লাহর কাছে কত বড় অপরাধী বলে গণ্য হবে এবং এই সমস্ত কর্মক্ষেত্রের কর্মচারিগণ কিভাবে অশ্লীলতা প্রসারের অপরাধ হতে অব্যাহতি পাবে?

এমনি ভাবে যারা নিজেদের বাড়িতে টিভি রেখে নিজের পরিবার ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের মধ্যে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছে, তারাই-বা অশ্লীলতা প্রসারের অপরাধী কেন হবে না? ঠিক অনুরূপভাবে অশ্লীলতা ও ইসলাম- বিরোধী কথায় পরিপূর্ণ বই বা মাসিক পত্র-পত্রিকা বাড়ির ভেতর প্রবেশ করাও অশ্লীলতা প্রসারের একটি কারণ। এটিও আল্লাহর কাছে অপরাধ বলে গণ্য হতে পারে।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, নিজেদের কর্তব্য অনুভব করা এবং অশ্লীলতার বন্যাকে বাধা দেওয়ার সাধ্যমত চেষ্টা করা। আল্লাহ তাআলা অশ্লীলতা ও সীমালঙ্ঘনের কাজকে নিষেধ করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

‘আল্লাহ ইনসাফ, ইহসান ও আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা, অসৎ কাজ ও সীমা লঙ্ঘন করতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদের উপদেশ দেন, যেন তোমরা শিক্ষা গ্রহণ করো।’ (সুরা : নাহল, আয়াত : ৯০)

অশ্লীলতা ও খারাপ কাজ থেকে বাঁচার দোয়া

অশ্লীলতা থেকে বেঁচে থাকা ঈমাদের দাবি। দুনিয়ার সব খারাপ কাজ, অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বাঁচতে আল্লাহর কাছে বেশি বেশি প্রার্থনা করা জরুরি। যেভাবে শিখিয়েছেন স্বয়ং নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। হাদিসের একাধিক বর্ণনায় তা ওঠে এসেছে-

১. হজরত যিয়াদ ইবনে ইলাক্বাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি তার চাচা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন-

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন মুনকারাতিল আখলাক্বি ওয়াল আ’মালি ওয়াল আহওয়ায়ি।’

অর্থ : হে আল্লাহ! নিশ্চয় আমি তোমার কাছে খারাপ চরিত্র, অন্যায় কাজ ও কুপ্রবৃত্তির অনিষ্টতা থেকে আশ্রয় চাই।’ (তিরমিজি)

২. হজরত আবু আহমাদ শাকাল ইবনু হুমাইদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম- আমাকে একটি দোয়া শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, তুমি বল-

উচ্চারণ : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আউজুবিকা মিন শাররি সাময়ি, ওয়া মিন বাচারি ওয়া মিন শাররি লিসানি ওয়া মিন শাররি ক্বালবি ওয়া মিন শাররি মানিয়্যি।’

অর্থ : ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে কানে মন্দ কথা শোনা থেকে আশ্রয় চাই। চোখ দিয়ে মন্দ কিছু দেখা থেকে আশ্রয় চাই। জিহ্বা দিয়ে মন্দ কিছু বলা থেকে আশ্রয় চাই। অন্তরের খারাপ চিন্তা থেকে আশ্রয় চাই। দেহের কামনা-বাসনার খারাপ চিন্তা থেকেও আশ্রয় চাই।’ (আবু দাউদ, তিরমিজি, নাসাঈ)

অশ্লীলতা ইসলামে নিষিদ্ধ। অশ্লীলতা মানব চরিত্র ধ্বংসের অন্যতম হাতিয়ার। অশ্লীলতা ভীষণ পাপের কাজ। আর মুসলিম সমাজে এর প্রচার-প্রসার আরও গর্হিত অপরাধ। তাই অশ্লীল সব কথা ও কাজ থেকে বিরত থাকা জরুরি।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে অশ্লীলতা ও বেহায়াপনা থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। কোরআন-সুন্নাহর আলোকে জীবন গড়ার তাওফিক দান করুন। দুনিয়া ও পরকালের ভয়াবহ শাস্তি থেকে বেঁচে থাকার তাওফিক দান করুন। আমিন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *