নবী-রাসুলরা কোন ভাষায় কথা বলতেন

নবী-রাসুলরা কোন ভাষায় কথা বলতেন

মাতৃভাষা আল্লাহর সেরা দান। আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে মানুষকে মনের ভাব ব্যক্ত করতে মাতৃভাষা দান করেছেন। ভাষা অন্যান্য প্রাণীর ওপর মানুষের শ্রেষ্ঠত্বের অন্যতম দিক। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘দয়াময় আল্লাহ, তিনিই শিক্ষা দিয়েছেন কোরআন, তিনিই সৃষ্টি করেছেন মানুষ, তিনিই তাকে শিখিয়েছেন ভাব প্রকাশ করতে।’ (সুরা আর- রহমান, আয়াত : ১-৪)

পৃথিবীতে বৈচিত্র্যময় ভাষা দান করেছেন। ভাষার এই বৈচিত্র্য আল্লাহর নিদর্শনের অংশ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর তাঁর নিদর্শনাবলির মধ্যে আছে আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য। এতে জ্ঞানীদের জন্য অবশ্যই বহু নিদর্শন আছে।’ (সুরা রুম, আয়াত : ২২)

নবীরা মাতৃভাষায় কথা বলতেন : আল্লাহ তাআলা সব নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষা দিয়ে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা নিজ নিজ জাতিকে মাতৃভাষায় আল্লাহর পথে আহ্বান করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘আর আমি প্রত্যেক রাসুলকে স্বজাতির ভাষাতেই পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে বর্ণনা দেয়। (সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ০৪)

আবু জর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ প্রত্যেক নবীকে তাঁর স্বজাতির ভাষায় প্রেরণ করেছেন। (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২১৪১০ )

আল্লামা ইবনে কাসির (রহ.) বলেন, ‘রাসুলরা মাতৃভাষাভাষী হওয়ার কারণ হচ্ছে, যেন তাদের জাতি রাসুল প্রেরণের উদ্দেশ্য এবং তাঁরা কী নিয়ে প্রেরিত হয়েছেন তা বুঝতে পারেন। (তাফসিরে ইবনে কাসির : ৪/৪৭৭)

মাতৃভাষায় দক্ষ ছিলেন রাসুলরা : নবী (আ.) শুধু মাতৃভাষায় ধর্ম প্রচার করেননি; বরং তাঁরা ছিলেন নিজ নিজ ভাষায় পাণ্ডিত্যের অধিকারী। সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আলংকারিক ভাষার কৃতিত্বধারী। পবিত্র কোরআনের একটি আয়াত থেকে যা অনুমান করা যায়। কোরআনে মুসা (আ.)-এর ভাষ্যে হারুন (আ.)-এর প্রশংসা করে বলা হয়েছে, ‘আর আমার ভাই হারুন, সে আমার চেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী, তাই তাকে আমার সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে প্রেরণ করুন, সে আমাকে সমর্থন করবে।’ (সুরা কাসাস, আয়াত : ৩৪)

নবীজি (সা.)-এর ভাষাগত দক্ষতা : শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দিস দেহলভি (রহ.) মহানবী (সা.)-এর ভাষাগত দক্ষতা সম্পর্কে লেখেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর মুবারক ভাষার বিশুদ্ধতা, একই বাক্যে বহু বাক্যের সমাবেশ, অভূতপূর্ব বাচনভঙ্গি, অমূল্য নির্দেশ ও সমাধান এত বেশি থাকত যা কোনো গবেষক ও চিন্তাবিদ কোনো সীমা ও গণনার মধ্যে আবদ্ধ করতে পারবে না। তাঁর ভাষার মাধুর্য, গভীরত্ব ও সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কেননা আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেয়ে অধিক শুদ্ধ ও সুমধুর ভাষার অধিকারী কাউকে সৃষ্টিই করেননি।

একবার ওমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) মহানবী (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন যে হে আল্লাহর রাসুল, না আপনি বাইরে ভিনদেশে কোথাও গেছেন, না আপনি বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে ওঠা-বসা করেছেন, তবু আপনি এত সুন্দর শুদ্ধভাষা কোথা থেকে পেলেন? রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ইসমাইল (আ.)-এর ভাষা ও পরিভাষা যা দুষ্প্রাপ্য ও বিলীন হয়ে গিয়েছিল তা আমার কাছে জিবরাইল (আ.) নিয়ে আসেন এবং তা আমি আত্মস্থ করেছি। উপরন্তু তিনি বলেন, আমার প্রভু আমাকে (আদব) ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন, ফলে আমার ভাষাকে অতি উত্তম করে দিয়েছেন। যে শিক্ষা আরবি ভাষা, তার শুদ্ধতা, অলংকার, সৌন্দর্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাকে আরবরা আদব বলে। (মাদারিজুন নুবুওয়াহ)

কোন নবীর ভাষা কী ছিল : কোরআনের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয় যে নবী-রাসুল (আ.) মাতৃভাষায় কথা বলতেন এবং মাতৃভাষাতেই মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতেন। নবী-রাসুলদের ভাষা সম্পর্কে যেসব ঐতিহাসিক বর্ণনা পাওয়া যায়, তা হলো—

১. আদম (আ.) : পৃথিবীর প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী আদম (আ.) জান্নাতে আরবি ভাষায় কথা বলতেন। তবে পৃথিবীতে আগমনের পর তিনি সিরিয়াক (ঝুত্রধপ) ভাষায় কথা বলেন। যাকে সিরিয়াক অ্যারামিক ভাষাও বলা হয়।

২. নুহ, শিশ, ইউনুস ও ইদরিস (আ.) সিরিয়াক ভাষায় কথা বলতেন।

৩. হুদ ও সালিহ (আ.) : আরবি ভাষায় কথা বলতেন।

৪. ইবরাহিম (আ.) : তাঁর মাতৃভাষা ছিল সিরিয়াক। তবে তিনি আরবি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন।

৫. লুত ও ইয়াকুব (আ.) : তাঁরাও সিরিয়াক ও আরবি উভয় ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।

৬. ইসমাইল, আইয়ুব ও শোয়াইব (আ.) : আরবি ভাষায় কথা বলতেন।

৭. ইউসুফ (আ.) : শৈশবে তিনি আরবি ভাষায় কথা বলতেন। তবে মিসরে আগমনের পর প্রাচীন মিসরীয় ভাষা কিবতি ভাষায় কথা বলতেন।

৮. দাউদ ও সুলাইমান (আ.) : অ্যারামিক (সিরিয়াক ভাষার উপভাষা ও হিব্রুর প্রাচীনরূপ) ভাষায় কথা বলতেন। তবে তাঁরা আরবি ভাষায়ও পারদর্শী ছিলেন।

৯. মুসা ও হারুন (আ.) : তাঁরা প্রাচীন মিসরীয় কিবতি ভাষায় কথা বলতেন। তবে তিনি মাদায়েনে হিজরত করার পর আরবি ভাষা রপ্ত করেন। তবে মিসরের বনি ইসরাঈলরা অ্যারামিক (হিব্রু ভাষায় কথা বলত।

১০. ইউশা বিন নুন (আ.) : তিনি মূলত আরবি ভাষায় কথা বলতেন। তবে প্রাচীন মিসরীয় কিবতি ভাষাও জানতেন। ১১. জাকারিয়া, ঈসা ও ইয়াহইয়া (আ.) : তাঁরা অ্যারামিক ভাষায় কথা বলতেন। তবে তাঁরা আরবি ভাষাও জানতেন।

১২. মুহাম্মদ (সা.) : তিনি আরবি ভাষায় কথা বলতেন। তিনি ছিলেন আরবের সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষার অধিকারী।

মতভিন্নতা ও সমাধান : নবীদের মাতৃভাষা নিয়ে ঐতিহাসিকদের ভেতর মতভিন্নতা আছে। তবে বেশির ভাগ মতের মধ্যেই সমন্বয় করা সম্ভব। যেমন ঈসা (আ.)-এর ভাষার বিষয়ে দুটি মত হলো অ্যারামিক ও হিব্রু। মূলত অ্যারামিক হলো হিব্রু ভাষার প্রাচীনরূপ। হিব্রু অ্যারামিকের বিবর্তিত রূপ। তাই মৌলিকভাবে উভয় মতের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

(ইন্টারনেট-)

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *