বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক আলেমের বিদায়

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এক আলেমের বিদায়

চলে গেলেন ভারতীয় উপমহাদেশের বর্ষীয়ান আলেম ও বিশ্বনন্দিত ইসলামী চিন্তাবিদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভির সুযোগ্য উত্তরসূরি সাইয়েদ মুহাম্মদ রাবে হাসানি নদভি (রহ.)। গত ২১ রমজান রোজ বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল ২০২৩) জোহরের সময় তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এই ইসলামী ব্যক্তিত্ব দেশ-বিদেশের বহু সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

তিনি একাধারে অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের বর্তমান সভাপতি, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামার বর্তমান রেক্টর, রিয়াদস্থ রাবেতাতুল আদাব আল-ইসলামীর সভাপতি এবং মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। একইভাবে তিনি লখনউস্থ মজলিসে তাহকিকাত ও নশারিয়তে ইসলাম, উত্তর প্রদেশের দ্বিনি তালিমি কাউন্সিল, রায়বেরেলির দারে আরাফাত, মাওলানা আবদুল বারি নদভি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়স্থ সেন্টার ফর ইসলামিক স্টাডিজ এবং আজমগড়ে অবস্থিত দারুল মুসান্নিফের সদস্য, পয়ামে ইনসানিয়াত ও ইসলামী ফিকহ একাডেমি ভারতের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এ ছাড়া মাওলানা আবুল কালাম আজাদ একাডেমি লখনউ, দারুল উলুম দেওবন্দের মজলিশে শুরা, আলীগড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যলয়ের উপদেষ্টা পরিষদ, দারুল উলুম বস্তির মজলিশে শুরা, আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভি একাডেমি, ভটকলেরও সদস্য।

শায়েখ রাবে হাসানি নদভি (রহ.)-এর জন্ম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২ অক্টোবর ভারতের উত্তর প্রদেশের রাইবেরেলিতে। পিতা রশিদ আহমদ ইবনে খলিলুদ্দিন হাসানি। পুরো নাম মুহাম্মম্মদ আর-রাবে। তাঁর পরিবার অভিজাত হাসানি বংশোদ্ভূত, যাঁদের পূর্বপুরুষ হিজরি ষষ্ঠ শতাব্দীতে আরব থেকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে এসে বসতি স্থাপন করেন। অতঃপর মোগল বাদশা আওরঙ্গজেব আলমগীরের আমলে রাইবেরেলিতে থিতু হন।

পারিবারিকভাবে জ্ঞান ও ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠেন শায়খ মুহাম্মদ রাবে। তাঁর মা ছিলেন আল্লামা সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভির সহোদরা। তাঁর হাতেই লেখাপড়ার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষার পর লখনউ চলে আসেন দুই মামা ডা. আবদুল আলী হাসানি ও আবুল হাসানী নদভি (রহ.)-এর সান্নিধ্যে। বিশেষত তিনি শায়খ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর শিষ্যত্ব লাভ করেন। অবশেষে ১৯৪৮ সালে নদওয়া থেকে ফারেগ হন। শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আধ্যাত্মিক দীক্ষাও লাভ করেন যুগশ্রেষ্ঠ বুজুর্গদের কাছে। যেমন মাওলানা আবদুল কাদের রায়পুরি (রহ.), শায়খুল হাদিস মাওলানা জাকারিয়া (রহ.) ও শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) প্রমুখ।

১৯৪৯ সালে তিনি দারুল উলুম নদওয়াতুল উলামায় আরবি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক নিযুক্ত হন। এরপর যথাক্রমে ১৯৫২ সালে আরবি সাহিত্যের ওস্তাদ, ১৯৫৫ সালে আরবি সাহিত্যের বিভাগীয় প্রধান, ১৯৭০ সালে আরবি ভাষা ও সাহিত্য অনুষদের ডিন নিযুক্ত হন। ১৯৯৩ সালে নদওয়াতুল উলামাস্থ দারুল উলুমের মহাপরিচালক শায়খ মুহিব্বুল্লাহ লারি নদভি (রহ.)-এর মৃত্যু হলে শায়খ রাবে হাসানিকে দারুল উলুমের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এদিকে তিনি দারুল উলুমের মূল প্রতিষ্ঠান নদওয়াতুল উলামার সহসভাপতি নিযুক্ত হন ১৯৯৮ সালে। আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভি (রহ.)-এর ইন্তেকালের পর ২০০০ সালের ৩ জানুয়ারি নদওয়াতুল উলামার সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০০২ সালে মাওলানা মুজাহিদুল ইসলামের ইন্তেকাল হলে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সভাপতিও নিযুক্ত হন ২০০৩ সালে। শায়খ মুহাম্মদ রাবে (রহ.) ১৯৫৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন পাক্ষিক আরবি পত্রিকা ‘আর-রায়িদ। যা নদওয়াতুল উলামা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। পাশাপাশি নিয়মিত লিখেছেন অন্যান্য পত্র-পত্রিকাতেও। এ ছাড়া তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় নদওয়াতুল উলামা থেকে আরো কয়েকটি পত্রিকা বের হয়। যেমন উর্দু ‘তামিরে হায়াত, হিন্দি ‘সাচ্চা রাহি’ এবং ইংরেজি পত্রিকা দ্য ফ্রেগ্রেন্স অব ইস্ট’ (The Fragrance of East)।

শায়খ রাবে (রহ.) আজীবন লেখালেখি ও সাহিত্যচর্চার সঙ্গে সংযুক্ত ছিলেন। মাতৃভাষা উর্দু ও আরবি ভাষায় তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কয়েকটি রচনা হলো, ১. কিমাতুল উম্মাতিল ইসলামিয়্যাতু ওয়া মুনাজাতুহা, ২. মাকালাতুন ফিত তারবিয়াতি ওয়াত তালিম, ৩. আল-আদাবুল আরবি বায়না আরদিন ওয়া নাকদ, ৪. তারিখুল আদব আল-আরবি, ৫. মানসুরাতুন মিন আদাবিল আরব ইত্যাদি।

আরবি ভাষা ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য শায়খ রাবে (রহ.) ১৯৮২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি পুরস্কার, আরবি সাহিত্যে ভারতীয় কাউন্সিল উত্তর প্রদেশ পুরস্কার, রামপুর মাকতাবাতু রেজা সম্মাননা ও পদক লাভে করেন। আল্লাহ তাঁকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং জান্নাতুল ফিরদাউস নসিব করুন। আমিন।

Related Articles

1 Comment

Avarage Rating:
  • 0 / 10
  • Gautam Pal , April 25, 2024 @ 2:23 pm

    Sad News.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *