সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি রেজাউল করিম

সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন পীর সাহেব চরমোনাই মুফতি রেজাউল করিম

বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ইসলামী আন্দোলনের মেয়র পদপ্রার্থী মুফতী সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমসহ নেতাকর্মীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ, অথর্ব সিইসি’র পদত্যাগ এবং জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিম।

আজ রোববার (১৮ জুন) দুপুর ১২টায় দলটির কেন্দ্রীয় কার্যলয়ে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ৮ দফা দাবি ও ২ কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীমসহ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর নেতাকর্মীদের ওপর আওয়ামী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বর্বরোচিত হামলা, বরিশাল, খুলনা সিটি নির্বাচনে ভোট ডাকাতির ধারা অব্যাহত রাখার প্রতিবাদ এবং বিকারগ্রস্ত প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ ও অথর্ব নির্বাচন কমিশন বাতিল এবং নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবীতে আজকের এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। আজকের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হয়ে আপনারা যে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন সে জন্য শুরুতেই সবাইকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ
দেশের রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ আপনারা জানেন। দেশের মানুষের ভোটাধিকার হরণে ক্ষমতাসীনদের রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের কথাও নতুন নয়।
গত ১২ জুন বরিশাল সিটি নির্বাচনে ঘটে যাওয়া হৃদয়বিদারক ঘটনা বিভিন্ন মাধ্যমে গোটা দেশবাসী অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছে। সরকারদলীয় সন্ত্রাসীরা কতটা নির্মম ও পৈশাচিকভাবে বাংলাদেশের একজন জননন্দিত আলেম ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতি সৈয়দ মোহাম্মদ ফয়জুল করীমকে দফায়-দফায় আক্রমন করেছে, চরমভাবে আপমান অপদস্ত করেছে এমনকি শারীরিকভাবে আক্রমন করে রক্তাক্ত করেছে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।

নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নিযুক্ত রির্টানিং কর্মকর্তা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বারবার অভিযোগ করেও মুফতি ফয়জুল করীম সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তো দূরের কথা তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাটুকুও পাননি। উপরন্তু ঘটনার পর সাংবাদিকগণের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব হাবিবুল আউয়াল একজন অবিবেচক উন্মাদের মতো মুফতি ফয়জুল করীমের শরীর থেকে রক্তক্ষরন নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ও উপহাস করেছেন। তিনি সাংবাদিকদেরকে পাল্টা প্রশ্ন করেছেন,‘তিনি (মুফতি ফয়জুল করীম) কি ইন্তেকাল করেছেন?’ একজন মানুষ কোন পর্যায়ের বিবেক বর্জিত হলে দেশের একজন সম্মানিত ব্যক্তির ব্যাপারে এজাতীয় বক্তব্য করতে পারেন, তা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে।
আমাদের দুর্ভাগ্য এমন একজন কান্ডজ্ঞানহীন বিকারগ্রস্ত মানুষ বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনারের চেয়ারে বসে আছেন।
আমরা অবিলম্বে প্রধান নির্বাচন কমিশনার জনাব হাবিবুল আউয়ালের পদত্যাগ চাই। তিনি পদত্যাগ করতে না চাইলে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় দ্রুত তাঁর অপসারন চাই।

পাশাপাশি আমরা বরিশালে মুফতি ফয়জুল করীমের উপর আক্রমনকারী এবং তাঁকে অপমান অপদস্তকারী সন্ত্রাসী এবং ভোট ডাকাত ও দস্যুদের দৃষ্টান্তমূলক বিচার দাবী করছি। এমন অসভ্য ঘটনার পেছনে যারা রয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের চিহ্নিত করার দাবী জানাচ্ছি।

যে সব রাজনৈতিক দল, ওলামায়ে কেরাম, পীর মাশায়েখ এবং সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ মুফতী ফয়জুল করীমের উপর সরকারদলীয় সন্ত্রাসী হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং আমাদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন; আমরা তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
দেশের মানুষ আজ আতঙ্কিত। দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা আজ চিন্তিত। দেশময় সংঘাত আর সহিংসতার অশনি সংকেত পাওয়া যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নবম জাতীয় সংসদে একতরফাভাবে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ করার পর থেকেই রাজনৈতিক সংকটে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। আমরা বারবার রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের দাবী জানিয়ে আসছি। দেশের প্রায় সব রাজনৈতিকদল এবং নাগরিকসমাজের প্রতিনিধিগণ সংকট সমাধানের উদ্যোগ গ্রহনের কথা বলে আসলেও, কার্যকর কোন উদ্যোগ গ্রহন করা হয় নাই। আওয়ামীলীগ সরকার দেশের নির্বাচন ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করে ফেলেছে। বিগত প্রায় ১৪ বছর দেশে কোন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়নি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতেও জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেনি। ক্ষমতাসীনরা তাদের দলীয় লোকদেরকে নির্বাচিত করার জন্যে এহেন কাজ নেই যা করেনি। নির্লজ্জভাবে মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন কেউই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেনি। ফলে নির্বাচনকে মানুষ এখন প্রহসন এবং তামাশা মনে করে। আগামীতে মানুষ আর তামাশা ও প্রহসনের নির্বাচন দেখতে চায় না।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ,
বর্তমান বিতর্কিত সরকারের ক্ষমতার মেয়াদ প্রায় শেষ প্রান্তে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারের পরিবর্তন হতে হলে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচন লাগবে। আমরা চাই একটি সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতার পালা বদল হোক। কিন্তু আগামী জাতীয় নির্বাচন কিভাবে হবে, তা এখনো পরিস্কার নয়।

ক্ষমতাসীনরা এবারও জাতীয় সংসদ বহাল রেখে গায়ের জোরে তাদের অধিনেই একটি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন করতে চায়। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, জাতীয় সংসদ বহাল রেখে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে, সেই নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহনযোগ্য হবে না। বরং আবারও ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের মতো নির্বাচনের নামে প্রহসন হবে। রাতের ভোটে নির্বাচিত বর্তমান সংসদের কোন নৈতিক বৈধতা নেই। এই অবৈধ সংসদ বহাল রেখে কোন নির্বাচন দেশবাসী মেনে নেবে না।

অতএব আমরা বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের অধীনে সকল দলের অংশগ্রহনে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন চাই।

প্রিয় সাংবাদিক বন্ধুগণ!
একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ মনে করে, বৈধ এবং শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা পরিবর্তনের মাধ্যম হলো নির্বাচন। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের অভিপ্রায়ের যথার্থ বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

এ জন্যেই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ১৯৮৭ সালে জন্মের পর থেকে ১৯৮৮ সালের ৩ রা মার্চ জাতীয় পার্টির অধিনে অনুষ্ঠিত হাস্যকর নির্বাচন, ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তৎকালীন বিএনপি সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত একতরফা নির্বাচন; এই তিনটি চরম বিতর্কিত এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বাকি সবগুলো অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনে জোটগতভাবে এবং এককভাবে অংশ নিয়েছে।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জনকল্যাণে নিবেদিত একটি দেশপ্রেমিক শান্তিকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে জনমতের প্রতি গভীরভাবে শ্রদ্ধাশীল।

তাই ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ প্রতিটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপের ক্ষেত্রে দেশের জনগণের অনুভূতি, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী শ্রেণীর পরামর্শ ও মতামত এবং সিভিল সোসাইটির পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণকে অধিকতর মূল্যায়ন করে থাকে।

এরই ধারাবাহিকতায় আমরা অচিরেই অন্যান্য প্রতিনিধিত্বশীল, দেশপ্রেমিক, রাজনৈতিক দল এবং বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ব্যাপক আলোচনা করে নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের বিস্তৃত রূপরেখা ঘোষণা করবো, ইনশাআল্লাহ।

আগামী দিনে দেশে শান্তি বজায় রাখার জন্যে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ক্ষমতা বদলের লক্ষ্যে আজকে আমরা মৌলিকভাবে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরছি,
১. জাতীয় সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্বেই জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে।
২. জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বর্তমান জাতীয় সংসদ ভেঙ্গে দিতে হবে।
৩. সংসদ ভেঙ্গে দেয়ার পাশাপাশি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন।
৪. জাতীয় সরকার গঠিত হওয়ার পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করবেন। কোনো কারণে তা সম্ভব না হলে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যে অবশ্যই নির্বাচন দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
৫. বর্তমান মন্ত্রীসভার কেউ’ই নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে থাকতে পারবেন না এবং জাতীয় সরকারে যারা থাকবেন তারা জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না।

নির্বাচনকালীন জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন :
জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল, দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবী মহল এবং সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিগণের সঙ্গে আলোচনা করে দ্রুতই আমরা জাতীয় সরকারে কারা থাকবেন এবং সরকার কাঠামো কি হবে তা প্রকাশ করবো, ইনশাআল্লাহ।

দাবীসমূহ:
১. যেকোন মূল্যে দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি রোধ করতে হবে। বাজার কারসাজীর সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে। লোডশেডিং-এর অসহনীয় যন্ত্রনা থেকে জাতীকে মুক্তি দিতে হবে।
২. অবিলম্বে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন ধরে কারাবন্দী সকল মজলুম আলেম এবং রাজবন্দিদের মুক্তি দিতে হবে।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় সংহতি ও কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচনে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতির (চ.জ) নির্বাচন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে।
৪. বরিশালে মুফতি ফয়জুল করীমের উপর আক্রমনকারী এবং তাঁকে অপমান অপদস্তকারী সন্ত্রাসী এবং ভোট ডাকাত ও দস্যুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। এমন অসভ্য ঘটনার পেছনে যারা রয়েছে সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে তাদের চিহ্নিত করতে হবে।
৫. গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে প্রণীত বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে।
৬. সকল রাজনৈতিক দলের জন্যে সভা-সমাবেশসহ সাংবিধান স্বীকৃত সকল রাজনৈতিক কর্মসূচী ও বাকস্বাধীনতা উন্মুক্ত করতে হবে।
৭. সরকারের নির্বাহী আদেশে বন্ধ সকল টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্র অবিলম্বে চালু করতে হবে।
৮. সাংবাদিক গোলাম রাব্বানী নাদিম, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডসহ সকল সাংবাদিক হত্যার দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

কর্মসূচী:
১. অথর্ব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদত্যাগ ও ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন বাতিলের দাবীতে নির্বাচন কমিশন কার্যালয় অভিমূখী গণমিছিল : ২১ জুন বুধবার, সকাল ১০টায়।
২. বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরন ও একটি সুষ্ঠু নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে করণীয় বিষয়ে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি এবং দেশের শীর্ষ ওলামা মাশায়েখ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় : ২৪ জুন শনিবার, সকাল ১০ টায়।
সবাইকে আবারো আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে শেষ করছি, আল্লাহ হাফেজ।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *