হযরত সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) -এর সংশয় নিরসন

হযরত সুলায়মান (আলাইহিস সালাম) -এর সংশয় নিরসন

(১) সুলায়মানের আংটি চুরি ও রাজত্ব হরণ :

বাক্বারাহ ১০২ : এবং সুলায়মানের রাজত্বে শয়তানগণ যা আবৃত্তি করত, তারা (ইহুদীরা) তার অনুসরণ করত।

তাফসীর জালালাইনে বলা হয়েছে, কারন এস (শয়তানেরা) জাদু হ’তে (আবৃত্তি করত), যা সুলায়মান-এর সিংহাসনের নীচে তারা দাফন করেছিল তাঁর রাজত্ব ছিনিয়ে নেওয়ার প্রাক্কালে। আমরা বলি, সুলায়মান (আঃ) একজন জলীলুল ক্বদর নবী ছিলেন। তিনি জাদুকর ছিলেন না বা জাদুর শক্তির বলে তিনি সবকিছুকে অনুগত করেননি। তাঁর সিংহাসনের নীচে কোন জাদুও কেউ লুকিয়ে রাখেনি। তাছাড়া তাঁর রাজত্ব ছিনিয়ে নেবার মত কোন অঘটন ঘটেনি এবং এমন কোন খবরও আল্লাহ বা তাঁর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে দেননি। এগুলি নবীগণের মর্যাদার বরখেলাফ এবং স্রেফ ইস্রাঈলী কল্পকাহিনী মাত্র।

অতএব উক্ত আয়াত সমূহের প্রকাশ্য অর্থ এই যে, সুলায়মান (আঃ)-এর অতুলনীয় সাম্রাজ্যে ঈর্ষান্বিত শয়তানেরা সর্বত্র রটিয়ে দেয় যে, জিন-ইনসান ও পশু-পক্ষী সবার উপরে সুলায়মানের একাধিপত্যের মূল কারণ হল তাঁর পঠিত কিছু কালেমা, যার কিছু কিছু আমরা জানি। যারা এগুলি শিখবে ও তার উপরে আমল করবে, তারাও অনুরূপ ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। তখন লোকেরা ঐসব জাদু বিদ্যা শিখতে ঝুঁকে পড়ল ও তাদের অনুসারী হ’ল এবং কুফরী করতে শুরু করল। বর্ণিত আয়াতে এর প্রতিবাদ করা হয়েছে এবং সুলায়মান (আঃ)-এর নির্দোষিতা ঘোষণা করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে যে, সুলায়মান জাদুর বলে নয়, বরং আল্লাহর দেওয়া ক্ষমতা বলে দেশ শাসন করেন। মূল কথা হ’ল, ইহুদীরা সকল নবীকে গালি দিয়েছে এবং সেভাবে সুলায়মান (আঃ)-কেও তোহমত দিয়েছে।

(২) হারূত ও মারূতের কাহিনী :

একই আয়াতে হারূত ও মারূত দুই ফেরেশতা সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে মাননীয় তাফসীরকার বলেছেন, ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, ‘তারা ছিলেন দু’জন জাদুকর। তারা জাদু শিক্ষা দিতেন’। অথচ তাঁরা জাদুকর ছিলেন না। বরং ফেরেশতা ছিলেন। যারা কখনোই আল্লাহর অবাধ্য ছিলেন না। জাদুকর বলে তাদের উপরে তোহমত লাগানো হয়েছে মাত্র।

এতদ্ব্যতীত বাহরুল মুহীত্ব, বায়যাবী প্রভৃতি তাফসীর গ্রন্থে যেমন বলা হয়েছে যে, (ক) আল্লাহ তাদেরকে পরীক্ষা স্বরূপ মানুষ হিসেবে দুনিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। পরে তারা মানুষের ন্যায় মহাপাপে লিপ্ত হয়। (খ) তখন শাস্তি স্বরূপ তাদের পায়ে বেড়ী দিয়ে বাবেল শহরে একটি পাহাড়ের গুহার মধ্যে আটকিয়ে রাখা হয়। যারা যেখানে ক্বিয়ামত পর্যন্ত অবস্থান করবে। (গ) আর যে সুন্দরী মেয়েটির সঙ্গে তারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয়েছিল, সে মেয়েটি আসমানে ‘যোহরা’ তারকা হিসেবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত ঝুলন্ত থাকবে’– এগুলি সব তাফসীরের নামে উদ্ভট গল্প মাত্র, যা সুলায়মানের শত্রু ইহুদী-নাছারাদের উর্বর মস্তিষ্কের ফসল ছাড়া কিছুই নয়।

মূল ঘটনা এই যে, ঐ সময় ইরাকের বাবেল বা ব্যবিলন শহর জাদু বিদ্যায় শীর্ষে ছিল। সুলায়মানের বিশাল ক্ষমতাকে শয়তান ও দুষ্ট লোকেরা উক্ত জাদু বিদ্যার ফল বলে রটনা করত। তখন নবুঅত ও জাদুর মধ্যে পার্থক্য বুঝানোর জন্য আল্লাহ হারুত ও মারুত নামক দু’জন ফেরেশতাকে সেখানে শিক্ষক হিসাবে মানুষের বেশে পাঠান। তারা লোকদের জাদু বিদ্যার অনিষ্টকারিতা ও নবুঅতের কল্যাণকারিতা সম্পর্কে বুঝাতে থাকেন। কিন্তু লোকেরা অকল্যাণকর বিষয়গুলিই শিখতে চাইত। যা কুরআনের উক্ত আয়াতে বর্ণিত হয়েছে।

(৩) সুলায়মানের (আঃ)-এর উপরে প্রদত্ত তোহমত :

ছোয়াদ ৩৪ : আমি সোলায়মানকে পরীক্ষা করলাম এবং তার আসনের উপরে রেখে দিলাম একটি নিষ্প্রাণ দেহ। অতঃপর সে বিনত হ’ল। এখানে তাফসীর জালালাইনে বলা হয়েছে,

‘আমরা তাকে তার রাজত্বের কারণে পরীক্ষা করলাম। সেটা এই যে, তিনি একজন মহিলাকে বিবাহ করেন, যার প্রতি তিনি আসক্ত হয়েছিলেন। ঐ মহিলা তার গৃহে তার অগোচরে মূর্তি পূজা করত। আর সুলায়মানের রাজত্ব ছিল তার আংটির কারণে। একদিন তিনি টয়লেটে যাবার সময় অভ্যাসবশতঃ আংটিটি খুলে তাঁর উক্ত স্ত্রী ‘আমীনা’-র নিকটে রেখে যান। এমন সময় একটি জিন সুলায়মানের রূপ ধারণ করে সেখানে উপস্থিত হয় ও তার নিকট থেকে আংটিটি নিয়ে নেয়।…অতঃপর সুলায়মান বেরিয়ে এসে দেখেন তাঁর সিংহাসনে অন্যজন বসে আছে এবং লোকেরা সবাই তাকে অস্বীকার করে।… অতঃপর সে বিনত হ’ল অর্থাৎ সুলায়মান কিছু দিন পরে তাঁর আংটির নিকটে পৌঁছে যান। অতঃপর আংটি পরিধান করে নিজ রাজ আসনে উপবেশন করেন।

আমরা বলি, এই ব্যাখ্যার মধ্যে মারাত্মক ত্রুটি রয়েছে। কেননা এই ব্যাখ্যা দ্বারা নবী ও তাঁর পবিত্র স্ত্রীদের মর্যাদাহানি করা হয়েছে। যেখানে নবীদের ইয্যতের হেফাযতের দায়িত্ব আল্লাহর, সেখানে এ ধরনের তাফসীর বাতিল প্রতিপন্ন হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। সুলায়মান (আঃ)-কে আল্লাহ পরীক্ষা করেছিলেন এবং সে পরীক্ষার ফলে তিনি আল্লাহর দিকে অধিকতর রুজু হয়েছিলেন। কুরআন মাজীদে এই ঘটনা আমাদেরকে শুনানোর উদ্দেশ্য হ’ল যাতে আমরাও কোন পরীক্ষায় নিপতিত হ’লে দিশেহারা না হয়ে যেন আল্লাহর দিকে অধিকতর রুজু ও বিনীত হই- একথা বুঝানো। এখানে মূল ঘটনা বর্ণনা করা আল্লাহর উদ্দেশ্য নয়। তার কোন প্রয়োজনও নেই এবং তার জানার যথার্থ কোন উপায়ও আমাদের কাছে নেই।

এ সম্পর্কে মাননীয় তাফসীরকার যে আংটির ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তাছাড়াও তাঁর আংটি শয়তানের করায়ত্ত হওয়া, ৪০দিন পরে তা মাছের পেট থেকে উদ্ধার করে পুনরায় সিংহাসন ফিরে পাওয়া ইত্যাদি গল্পকে হাফেয ইবনু কাছীর স্রেফ ইস্রাঈলী উপকথা বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

নবী সুলায়মানের স্বীয় স্ত্রীদের সাথে ঘটনার যে বিবরণ ছহীহ বুখারী সহ অন্যান্য হাদীছ গ্রন্থে এসেছে, সেটিকে ক্বাযী আবুস সউদ, আল্লামা আলূসী, আশরাফ আলী থানভী প্রমুখ মুফাসসিরগণের ন্যায় অনেকে অত্র আয়াতের তাফসীর ভেবেছেন। কিন্তু সেটাও ঠিক নয়। ইমাম বুখারী স্বয়ং উক্ত হাদীছকে অত্র আয়াতের তাফসীরে আনেননি। বরং বিভিন্ন নবীর ঘটনা বর্ণনার ন্যায় রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুলায়মান নবী সম্বন্ধেও একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন মাত্র। অত্র আয়াতের শানে নুযূল বা ব্যাখ্যা হিসাবে নয়। উল্লেখ্য যে, ই.ফা.বা. ঢাকা-র অনুবাদের টীকাতেও উক্ত ঘটনাকে অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় আনা হয়েছে (পৃঃ ৭৪৪ টীকা ১৪১)। যা নিতান্তই ভুল।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *